দূর্নীতি মাপার নীতিহীনতা

এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

বিভিন্ন সময়ে দেশের মানুষ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে নানান ধরনের চটকদার স্লোগান শুনে থাকেন । কিন্তু সেই স্লোগান বাস্তবে কতটা কাজে আসে সেটা দেশের নাগরিক মাত্রই ভালোই জানেন । আগে শোনা যেত ‘ পোলিও মুক্ত ভারত ’ কিংবা ‘ গরিবি হটাও ’ স্লোগান । ইদানীং বলা হচ্ছে ‘ প্লাস্টিক মুক্ত ভারত ‘ কিংবা ‘ কংগ্রেস মুক্ত ভারত ’ – এর স্লোগান । কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় দেশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল কেন্দ্রে সরকারে থাকলেও ‘ দুর্নীতি মুক্ত ভারত ’ -এই স্লোগানটির কথা কেউ বলেননি । আসলে ‘ দুর্নীতি ’ শব্দটা এমনই এক শব্দ , পৃথিবীর এমন কোনও প্রান্তে নেই, যেখানে মানুষ এই শব্দের সঙ্গে পরিচিত নন।

আর দুর্নীতি মুক্ত কোনও দেশই যে বাস্তবে সম্ভব নয় সেটাও সকলেই কম বেশি স্বীকার করবেন । তাই ‘ দুর্নীতি মুক্ত ভারত ’ বা ‘ দুর্নীতি মুক্ত দেশ ’ এই ধরনের স্লোগান নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা , এটা যে কল্পনার রাজ্যেই সম্ভব এটা সব রাজনৈতিক দলই বুঝতে পারেন । আর তাই দেশ স্বাধীন হওয়ার এতগুলো বছর কেটে গেলেও অনেকগুলো সরকার এ দেশের ক্ষমতায় আসীন হয়েছে । কিন্তু কোনও সরকারই দুর্নীতি বন্ধ করতে পারেননি । হয়তো দুর্নীতি ইস্যুতে সব সরকারই সরব ছিলেন । কিন্তু দুর্নীতি নিরসনে সরকারগুলো যার যার নিজের মতো করে দেশের প্রচলিত আইনকে প্রয়োগ করে গেছেন ।

এই দীর্ঘ সময়ে শাসকের রং বদলেছে , বদলেছে শাসকের আচরণ । শাসকের কাজের ধরন নীতিবোধ , ভাষা সবই সময়ে সময়ে পরিবর্তন হয়েছে । কিন্তু দুর্নীতি বন্ধ চরণ । শাসকের কাজের ধরন হয়নি । শাসকের রং বদলের সাথে দুর্নীতি ও নিজের রং বদলেছে । আগে হয়তো দুর্নীতি ছিল লক্ষ লক্ষ টাকার । এখন দুর্নীতি কোটিকোটি টাকার পাহাড়ে গিয়ে ঠেকেছে । আগে হয়তো টেবিলের তলা দিয়ে ফাইলের সঙ্গে দুর্নীতি দৌড়ঝাঁপ করতো । আর আজকাল দুর্নীতি স্কুলে ভর্তি হওয়া থেকে শুরু করে চাকরি পাওয়া , কাজ না করে ঠিকাদারির বিল পাওয়া , এমনকি দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে বহু লক্ষ কোটি ডলার কমিশনের মধ্যে দুর্নীতি নিজের শক্তপোক্ত ভিত গড়ে তুলেছে ।

তাই দুর্নীতি , লুটপাঠ , নোটের পাহাড় এসব দেখে দেখে অভ্যস্ত সাধারণ মানুষের কাছে নেতা – মন্ত্রী চামচাদের দুর্নীতির এসব ঘটনা তেমন করে আর আন্দোলিত করে না । যদিও আমাদের দেশে দুর্নীতি দমন ও দুর্নীতি নির্ধারণের জন্য হরেক নামের অসংখ্য সরকারী তদন্তকারী সংস্থা রয়েছে । আছে সিবিআই , আছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডি । এছাড়া ইনকাম ট্যাক্স দপ্তর , আদালত নিযুক্ত তদন্তকারী দল , রাজ্য সরকারের বিশেষ তদন্তকারী দল , পুলিশ এরা তো আছেই । এর মধ্যে খাতায় কলমে সিবিআই হলো স্বশাসিত সংস্থা । যদিও সুপ্রিমকোর্টের মতে তারা হলো খাঁচাবন্দি তোতাপাখি ।

এত কিছুর পরেও ২০১১ সালে কেন্দ্রের তদানীন্তন ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগে যখন বিপর্যস্ত দশা , গান্ধীবাদী আন্না হাজারে যখন যন্তর মন্তরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাতদিন এক করে উত্তাল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছেন , তখন দেশে এল লোকপাল বিল । কেন্দ্রে ইউপিএ গিয়ে এনডিএ সরকার এলো । কিন্তু দুর্নীতি আদৌ কি শেষ করা সম্ভব হলো ? হলো না । বরং লোকপালের ডানা ছাঁটাই করে তাকে নখদন্তহীন করা হলো । যে লোকপালে কথা ছিল প্রধানমন্ত্রী থেকে পুলিশ সবার বিরুদ্ধে তদন্ত করা যাবে , সময়ের হাত ধরে সেটাও বদলে গেল । ফলে দুর্নীতি এখন আর পাঁচটা সাধারণ ঘটনার মতোই ডাল ভাত হয়ে গেছে

আর সবচেয়ে যে অভিযোগ উদ্বেগের তা হলো , দুর্নীতির তদন্তকারী সংস্থাও এখন রাজনীতির রং বিচার করে তদন্তে হাত বাড়ায় । কেন্দ্রে দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের সময় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠে । কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস । অথচ দুর্নীতির অভিযোগে কালমাদি থেকে কানিমোঝি গ্রেপ্তার হয়ে যান । অথচ বিস্ময়কর হলো , ২০১৪ সালে কেন্দ্রে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার ক্ষমতায় বসে ।

কিন্তু অভিযোগ হলো গত ৮ বছরে দুর্নীতির তদন্তকারী সংস্থাগুলো বিরোধী রাজনৈতিক দলের দুর্নীতিগ্রস্তনেতাদের বিরুদ্ধে জেরা , জিজ্ঞাসাবাদ , গ্রেপ্তারিতে সক্রিয় হলেও এই পর্যন্ত গেরুয়া শাসিত রাজ্যে কোন ক্ষেত্রেই গ্রেপ্তার বা জিজ্ঞাসাবাদে দূরে থাকুক দুর্নীতি দমনে অভিযানের কোনও নজির রাখতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থাগুলো । ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলায় প্রথমে রাহুল গান্ধী ও পরে কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীকে ইডির তলব , কিংবা আম আদমি পার্টির সত্যেন্দ্র জৈনের গ্রেপ্তারি , কিংবা গত ফেব্রুয়ারীতে মহারাষ্ট্রের সংখ্যালঘু দপ্তরের মন্ত্রীকে গ্রেপ্তার , মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনিল দেশমখের বাড়িতে ইডির তল্লাশি , চিদাম্বরম পুত্র কীর্তি চিদাম্বরমের গ্রেপ্তার , কর্ণাটকে কংগ্রেস সভাপতি ডি শিবকুমারকে গ্রেপ্তার , ২০১৬ তে অখিলেশ প্রসাদের বাড়িতে সিবিআই হানা , প্রয়াত কংগ্রেস নেতা আহমেদ প্যাটেলকে ২০১৮ সালে ইডির মামলার যুক্ত করা সহ একাধিক ঘটনা

তদন্তের নামে এই পক্ষপাতিত্বর অভিযোগকেই কিন্ত প্রশ্নচিহ্নের মুখে এনে দা করিয়েছে । সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গ্রেপ্তারের পর তেলেঙ্গানার ক্ষমতাসীন টিআরএস দলের সভাপতি যখন প্রশ্ন তুলেন ইডি,আয়কর বা সিবিআই এ পর্যন্ত কতজন ‘ হরিশ্চন্দ্রের বংশধর বিজেপির নেতাদের বাড়িতে হানা দিয়েছেন তখন কিন্তু একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় রাজনীতির রং দেখে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা হলে এদেশে দুর্নীতির কোনওদিনই হয়তো শেষ হবে না । এটা তদন্তকারী সংস্থার স্বচ্ছতাকে যেমন কলঙ্কিত করে তেমনি সরকারের ভাবমূর্তিকে ক্ষুন্ন করে ।

Dainik Digital

Share
Published by
Dainik Digital

Recent Posts

নিগো – অন্ধ প্রশাসন!!

নিগো বাণিজ্যের রমরমা চালানোর জন্যই কি ১৮ সালে রাজ্যের মানুষ বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছিলো?রাজ্যের আকাশ…

15 hours ago

বিমানযাত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যু নিয়ে পুলিশের তদন্ত শুরু!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-এয়ারইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের কর্মীর চরম গাফিলতি ও উদাসীনতার কারণে রীতা বণিক (৫৯) বিমান যাত্রীর…

16 hours ago

হরিয়ানাঃ পাল্লা কার পক্ষে?

হরিয়ানা কি বিজেপির হাত থেকে ফসকে যাচ্ছে?শাসক বিজেপির হাবভাব দেখে তেমনটাই অনুমান করছে রাজনৈতিক মহল।প্রধানমন্ত্রী…

2 days ago

রাজধানীতে চাঁদার জুলুমে অতিষ্ঠ মানুষ!!

অনলাইন প্রতিনিধি:-মুখ্যমন্ত্রীডা. মানিক সাহার নির্বাচনি এলাকার আপনজন ক্লাবের চাঁদার নামে বড় অঙ্কের তোলাবাজির অভিযোগের রেশ…

3 days ago

ইন্ডিয়ান বুকে রাজ্যের মেয়ে ঝুমা!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-ইচ্ছে ছিলো অনেক আগে থেকেই। অবশেষে নিজের ইচ্ছেকেই বাস্তবে পরিনত করলো ঝুমা দেবনাথ।…

3 days ago

সুশাসনে আইনশৃঙ্খলা!

রাজ্যে কি সত্যিই আইনের শাসন রয়েছে?সাধারণ মানুষ কিন্তু প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে।সরকার বলছে রাজ্যে সুশাসন…

3 days ago