দূর হোক অজানা ভয়
মৃত্যুর চেয়ে মৃত্যুভয় অধিকতর ভয়ঙ্কর। অজানা ভয়, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ফিয়ার অফ আননোন। জগতের এই সারসত্যটি গুলে খেয়েছে হাড়হিম সন্ত্রাসের রক্তচক্ষু দেখানো জঙ্গিরা। মণিপুর প্রশাসনিক পদক্ষেপের সর্বৈব ব্যর্থতার সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে ‘অজানা ভয়’ ছড়াতে এবার মাঠে নেমেছে ‘পামরা’ (দ্য পিস অ্যাকর্ড এমএনএফ রিটার্নিজ’ অ্যাসোসিয়েশন) নামে মিজোরামে একটি প্রাক্তন জঙ্গি সংগঠন। রীতিমতো বিবৃতি প্রকাশ করে তারা মিজোরাম থেকে মেইতেইদের রাজ্য ছাড়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে।ওই সংগঠনের তরফে বিবৃতিতে বলা হয়েছে,মিজোরামে এরপর মেইতেইদের উপর কোনও অত্যাচারের ঘটনা ঘটলে মেইতেইরাই দায়ী থাকবে। প্রাক্তন জঙ্গি সংগঠনটি আরও বলেছে, মণিপুরে নারী নিগ্রহের বীভৎস ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পরেই মিজো যুবকেরা ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন। নিজেদের ‘নিরাপত্তার স্বার্থেই’ মেইতেইদের রাজ্য ছাড়া উচিত।অবশ্য সুখের কথা, ওই বিবৃতি সামনে আসার পরেই মিজোরামে মেইতেইদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গা। এ ব্যাপারে মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংয়ের সঙ্গে তিনি টেলিফোনে কথাও বলেছেন। অল মিজোরাম মণিপুরি অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে বৈঠকে করেছেন মিজোরামের স্বরাষ্ট্র সচিব লালেংমাওয়াইয়া।ওই সংগঠনের নেতাদের বলা হয়েছে, মেইতেইদের কাছে সরকারের বার্তা পৌছে দিতে সংগঠনের নেতাদের অনুরোধ করেছেন তিনি।মেইতেই সম্প্রদায়ের সরকারী কর্মচারী এবং ছাত্রদের কাছে একই আর্জি জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র সচিব।আইনের শাসন প্রয়োগ করে মানুষকে নির্ভয়ে রাখবে সরকার,গণতন্ত্রের পাঠ এটাই। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক দেশে রাজনীতির নামে নিরবিচ্ছন্ন বিকৃত পৌরুষের প্রদর্শন ঘটতে থাকলে তার ফল যে কতখানি মারাত্মক হয়, তুলনারহিত দৃষ্টান্ত আজ মণিপুর। কবে সেখানকার জনসমাজ আবার নিশ্চিন্তে প্রাত্যহিক স্বাভাবিকতায় ফিরে যেতে পারবে, সেই উত্তর এখনও ঝাপসা।মণিপুরে হিংসার আবহ কাজে লাগিয়েই পড়শি রাজ্যে ‘পামরা’ অজানা ভয় ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগটি নিয়েছে। স্বস্তির খবর, এখনও পর্যন্ত মিজোরামে কোনও হিংসার খবর সামনে আসেনি। কিন্তু আসতে কতক্ষণ, ‘পামরা’ কিন্তু মানুষের মনে অজানা আশঙ্কার বারুদে অগ্নিসংযোগ করে দিয়েছে। বিষবৃক্ষের চারা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করতে হয়। তাই সদ্যোজাত এই আগুন অবিলম্বে প্রশমিত না হলে ফুলকি স্ফুলিঙ্গ হতে বেশি সময় নেবে না।মণিপুর ছাড়াও মেইতেইদের একটি অংশ মিজোরামে বাস করেন। এছাড়া অসমে কিছু মেইতেই সম্প্রদায়ের বাসিন্দা রয়েছেন। প্রাক্তন জঙ্গিদের ওই বিবৃতি প্রকাশের পর থেকেই, সরকারের অভয়াবাণীরা তোয়াক্কা না করে, বিমান এবং সড়কপথে মেইতেইরা মিজোরাম ছাড়তে শুরু করেছেন।এই পরিস্থিতি কেবল দুর্ভাগ্যজনক নয়, অত্যন্ত বিপজ্জনক। মিজোরাম থেকে মেইতেইদের অভিবাসনে অচিরে লাগাম পরাতে হবে। শুধু মিজোরাম বলে নয়, যে কোনও রাজ্যে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে নিরাপদে রাখা শাসকের একান্ত কর্তব্য। মণিপুরের হিংসার ব্যাপকতা মাথায় রেখে সংসদে এ নিয়ে আলোচনা হওয়ার দরকার। এই রকম পরিস্থিতিতে সরকার এবং বিরোধী, পারস্পরিক আলোচনায় রাজনৈতিক ঐক্যমত তৈরি হওয়া অতীব জরুরি।কিন্তু “ফিয়ার অফ আননোন’ দূর করবে কে, সেটাই বড় প্রশ্ন। অজানা ভয় কি শুধু সন্ত্রাসীরাই দেখায়?বোধহয় না। নির্বাচন এলেই এমন ‘অজানা ভয়’-এর বেসাতি দেশের প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দলের প্রচারের পরতে লুকিয়ে থাকে। সমাজবিজ্ঞানীদের একাংশের অভিমত, ‘অজানা ভয়’ নাকি ভোটবাক্সে নিজেদের চিহ্নে ব্যালট গুণতি বাড়ানোর একটি পরীক্ষিত অস্ত্র। ‘আমি’ ক্ষমতায় এলে কী করতে পারি, তা প্রচার কিংবা বিশ্বাস করানোর তুলনায় ‘আমি’ না এলে কী হবে, সেই ভয় ধরানো নাকি অনেক সহজ।কিন্তু এই সময়ে, বিশেষত পূর্বোত্তরের মতো সংবেদনশীল জনসমাজে শাসক অথবা প্রশাসক, কোনও তরফেই ভীতি প্রদর্শন নাম্য নয়। কাম্য শান্তি এবং ভালবাসার বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া। ১৮৯৭সালে কাশ্মীর থেকে স্বামী ব্রাহ্মানন্দকে এক চিঠিতে মানবপ্রেম স্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দ লিখেছিলেন, ‘প্রেমের প্রভাবে অচেতন ড়বস্তু চেতনে পরিবর্তিত হয়। আমাদের বেদান্তের এটাই সার কথা।
প্রেম হবে ব্রজের মতে দৃঢ় অথচ কুসুমের মত কোমল-এটিই হচ্ছে।