দোদুল্যমান মুখের সারি
কল বাদে পরশু, বৃহস্পতিবার পূর্ব মুম্বাইয়ের ভাকোলায় গ্র্যান্ড হায়াত হোটেলে শিবসেনার আতিথ্যে বসবে ছাব্বিশ বিরোধী দলের জোট ‘ইন্ডিয়া’ (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স)-র তৃতীয় বৈঠক। অতিথি-অভ্যাগতদের জন্য হোটেলের দেড়শোটি ঘর ইতোমধ্যে ভাড়া নেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন হল, সাত মন তৈল পুড়ায়ে আখেরে কী ‘থালি’ প্রসব হইবে? নেতিবাচক ভোট সম্বল করে একটি ছোট রাজ্যে তবুও ক্ষমতায় আসা যায়, এত বিশাল দেশে সম্ভব নয়। জরুরি বিকল্প রাজনৈতিক ভাষ্য, ততোধিক জরুরি বিকল্প নেতৃত্বগুণ। এহ বাহ্য। পাটিগণিতের বাইরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ব্যক্তিগত গগণচুম্বী জনপ্রিয়তার প্রতিস্পর্ধী বিরোধী জোটের সমচারিত্রিক কোন নেতাকে দেখে আসমুদ্রহিমাচল হিন্দোলিত হয়ে উঠবে ? ইন্ডিয়া টুডে ও সি-ভোটারের যৌথ উদ্যোগে সম্পন্ন ভোট-অভিমুখী ভারতে ‘মুড অফ দ্য নেশন’ শীর্ষক সমীক্ষায় সম্প্রতি উঠে এসেছে, এই মুহূর্তে দেশে নির্বাচন হলে মোদির নেতৃত্বাধীন এনডিএ ৩০৬টি নয়াদিল্ল আসন নিয়ে ক্ষমতাসীন হবে। ফলে, সোমবার কলকাতায় দলীয় জনসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগামী লোকসভা নির্বাচন এগিয়ে এনে ডিসেম্বর বা জানুয়ারীতে বিজেপি সেরে ফেলতে চায় বলে সন্দেহ প্রকাশ করে এবং তার আগেই তার দলের মুখ্য সেনাপতি তথা বিতর্ক ভ্রাতুষ্পুত্র অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে গ্রেপ্তারের চেষ্টা হতে পারে নতুন বলে যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, তার অন্তর্নিহিত কারণটি তাৎপর্যপূর্ণ। এক্ষণে কারও যদি মনে হয় যে মমতার অবস্থান দোদুল্যমান, অস্বাভাবিক নয়।এমতাবস্থায় রাহুল গান্ধীকে বাদ দিলে ইন্ডিয়া জোটের অন্যতম চার চরিত্র নীতীশ কুমার, শারদ পাওয়ার, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অরবিন্দ চিন কেজরিওয়ালদের ভূমিকা শেষ পর্যন্ত কী হবে তা পাহাড়ি আবহাওয়ার মতোই অনিশ্চিত। রাজনীতি যেহেতু সম্ভাবনার শিল্প, তাই শেষ পর্যন্ত জোটের প্রতি এরা নিবেদিতপ্রাণ থাকবেন, নাকি বিজেপি তাদের মনে চুপিসাড়ে সিঁদ কাটবে, দেবা ন জানন্তি কুতো মনুষ্যা !সার্বিক প্রেক্ষাপটে নীতীশ অত্যন্ত ‘উল্লেখযোগ্য’ চরিত্র। তার মনে যে কয়জনা বসত করে, কখন যে কোন মন ছবি আঁকে আর কোন মন রং মাখে, বুঝে উঠা দুষ্কর। তার নিজের রাজ্য বিহারে নিন্দুকেরা তাকে ‘পাল্টিমামা’ বলে ব্যঙ্গ করেন। বিহারে বিজেপির সঙ্গ ছেড়ে এই নীতীশই সর্বাগ্রে উদ্যোগী হয়ে বিরোধী জোট তৈরিতে সূত্রধারের ভূমিকা নেন। নীতীশকে গুরুত্ব দিতেই জোটের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় তার খাস তালুক পাটনায়। কিন্তু বেঙ্গালুরুতে দ্বিতীয় বৈঠকে জোটের নামকরণের প্রশ্নে কংগ্রেস ও তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে মতপার্থক্যের জেরে তার নাকি গোঁসাও হয়।
দ্বিতীয় চরিত্র কেজরিওয়াল। দিল্লীতে তাকে কার্যত ঠুটো করে রেখেছে কেন্দ্রীয় সরকার। হয়তো শিখ ভোটব্যাঙ্কের দিকে চেয়ে ভগবন্ত মানকে ‘ছাড় দেওয়া হচ্ছে। দিল্লী ও পাঞ্জাবে কেজরির দল ক্ষমতায় থাকলেও বিগত দুটি লোকসভা নির্বাচনে কেজরি ব্যর্থ। বঙ্গে কংগ্রেস যেমন তৃণমূলের চক্ষুশূল, দিল্লীতে আপেরও তাই। ফলে ওই দুই রাজ্যে জোটের ভবিতব্য ধোঁয়াশায় ভরা। হাতে রইলেন পাওয়ার। মহারাষ্ট্রে আজও ভোটারদের বৃহদংশে তার গ্রহণযোগ্যতা থাকলেও ভ্রাতুষ্পুত্র অজিত হাতছাড়া হওয়ার পর শেষ অবধি তিনি কোন তরীতে সওয়ার হবেন, নাকি বাধ্যত দুই নৌকায় পা রেখে চলবেন, কোটি টাকার প্রশ্ন। এই চতুষ্টয়ের বাইরে পঞ্চম একটি চরিত্র আছে, যিনি এখনও পর্দানসীন। তিনি মায়াবতী। সংখ্যার শক্তিতে মায়াবতীকে প্রান্তিক অক্ষ মনে হলেও দেশজুড়ে বহুজন সমাজ পার্টির যে সমর্পিত ভোটব্যাঙ্ক রয়েছে, কংগ্রেস বাদ দিলে বিরোধী শিবিরের কোনও দলের তা নেই। উনিশের নির্বাচনে বিজেপি ও কংগ্রেসের পরে শুধুমাত্র বঙ্গে ভর করে তৃতীয় শক্তি হিসাবে তৃণমূল উঠে এলে মায়ার দল ছিল চতুর্থ স্থানে। এনডিএ বা ইন্ডিয়া, মায়াবতী এখনও কোনও পক্ষে নেই। মোদি সরকারের বিরুদ্ধে বড় দুই ইস্যু মুদ্রাস্ফীতি এবং বেকারত্ব। কিন্তু সেই অস্ত্র হাতে যথাযথভাবে জনগণের সামনে দাঁড়িয়ে আলোড়ন তোলার জন্য যে পরিমাণ রসদের প্রয়োজন, বিরোধীদের তা নেই। ফলে, শাসকের তুলনায় তাদের নির্বাচনি প্রচারের ব্যবস্থাপনা দুর্বল হতে বাধ্য। যদিও এটাও প্রমাণিত সত্য যে, ভোটদাতার মর্জি ভিন্ন দিকে ঘুরে গেলে টাকা দিয়ে তা ফেরানো যায় না। প্রশ্ন এখানেই মুখের সারি যেখানে দোদুল্যমানতায় ভরা, সেখানে কেন ভোটদাতার মর্জি বিপরীত দিতে ঘুরে যাবে ?