দোষারোপে জল নামে না

 দোষারোপে জল নামে না
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

বৃষ্টির জলে হাবুডুবু আগরতলা লইয়া নানান রকম মন্তব্যের ছড়াছড়ি । এই দুর্ভোগ লইয়াও দুই পক্ষে ভাগ হইয়া পালা করিয়া আহা হাহা হিহি হুহু করিতেছেন । এক পক্ষের মতে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসিয়া পরের বছরেই জলমগ্নতা কাটাইয়া তুলিবার প্রতিশ্রুতি দিল । এই প্রতিশ্রুতি কোনও নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি ছিল না । ইহা ছিল ভোটে জিতিয়া মুখ্যমন্ত্ৰী হইয়া এক দুপুরের বৃষ্টিতে জলমগ্ন বনমালীপুরের দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াইয়া নিজস্ব উক্তি । তাহার বাহিরে নির্বাচনি ইস্তাহারের প্রতিশ্রুতি তো ছিলই । কিন্তু এই সরকারের মেয়াদ শেষের মুখে আসিয়া দেখা গেলো আগরতলার জলমগ্নতার কিছুমাত্র সমাধান হইল না । অথচ গত দুই – তিন বৎসরে প্রচারকেরা প্রচার করিয়া দিল আগরতলায় এখন আর জল জমে না । বৃষ্টির জল দ্রুত বাহির হইয়া যায় । কিন্তু কোথায় কি ! সেই সকল প্রচারের ফানুস ফাটিয়া গেল একলহমায় , বৃহস্পতিবারের দুই ঘন্টার বৃষ্টিতে।

আগরতলার বুকে জল জমিবে না— এই কথা বলিবার অধিকার কেবল রাখিবে অর্বাচীন । কারণ জলমগ্নতা লইয়া অতীতে যে সমীক্ষা হইয়াছে তাহাতে জানা যায় আগরতলার ভূত্বক দেখিতে অনেকটা কড়াইয়ের মতন । ইহার তলদেশ হইতে পারে শকুন্তলা রোড কিংবা আরএমএস চৌমুহনী হইতে বনমালীপুর অঞ্চল । অর্থাৎ চারিদিক হইতে জল আসিয়া এইখানে দাঁড়াইবে এবং একসময় স্বাভাবিক গতিতে নিষ্ক্রান্ত হইবে । প্রশ্ন আসে , স্বাভাবিক গতি কী ? বৃষ্টির জল মাটিতে পড়িলে মাটি সেই জল শোষণ করিবে এবং ধারণ করিবে , ইহাই হইল স্বাভাবিক গতি । এই গতিপথ হইল পুকুর , জলাশয় কিংবা খোলা মাঠ । প্রশ্ন আসে , নগরে খোলা মাঠ কই , কই আছে পুকুর জলাশয় ? দিনে দিনে জল যেমন বুজাইয়া ফেলা হইতেছে , তদ্রূপ কখনও নগরোন্নয়ন , কখনও স্মার্ট সিটির নামে সারা নগর কংক্রিটের চাদরে ঢাকিয়া দেওয়া হইতেছে । এই সকল উন্নয়নের সন্ত্রাসে নির্বিচারে কাটিয়া ফেলা হইতেছে সকল প্রাচীন , নবীন গাছ ।
ব্যক্তিগতভাবে বৃক্ষচ্ছেদনের পাশাপাশি সরকারী আয়োজনের বৃক্ষচ্ছেদনের ঘটনাসমূহ কম শোচনীয় নহে । ইহা না হয় উহ্য রহিল । কিন্তু ঘটনা হইল কংক্রিটের চাদরের কারণে আগরতলায় বৃষ্টির জলের সহিত মাটির দেখা হইতেছে না । ফলত জল গতিহীন হইয়া দাঁড়াইয়া পড়িতেছে । স্মার্ট সিটি প্রকল্প আসিবার আগেও এই শহরের জলমগ্নতা কাটাইতে নানান চেষ্টা হইয়াছে । যেমন অপেক্ষাকৃত নিচু রাস্তাগুলিকে উঁচু করিয়া লওয়া । ইহাতে রাস্তা উঁচু হইলেও এলাকাগুলি নিচুই থাকিয়া যায় । বাধ্য হইয়া বাড়িঘরগুলি ভাঙ্গিয়া উঁচু করিতে হয় রাস্তার সহিত সাযূজ্য রক্ষায় । ইহার ফলে আগে যে সকল এলাকা উঁচু বলিয়া কখনওই বৃষ্টির জল জমে নাই সেই সকল এলাকায় অর্থাৎ নতুন নতুন এলাকা ডুবিতে শুরু করে । এই ঘটনা স্মার্ট সিটি আগরতলায় এই বৃষ্টিতেও দেখা গেল ।

আবার এই শহরের জল নিকাশি ব্যবস্থা হইল তিনখানা ড্রেইন । সব কয়টারই গন্তব্য বাংলাদেশ । আখাউড়া খাল , কালাপানিয়া খাল আর উত্তর প্রান্তে পূর্ব হইতে পশ্চিমে বাংলাদেশে চলিয়া যাওয়া আরও একটি খাল । এই বৃহস্পতিবার কালাপানিয়া খাল দিয়া জল নামিয়াছে স্বাভাবিকভাবে । কিন্তু ব্যাহত হইয়াছে আখাউড়া খাল । কারণ নিচের দিকে কিছু কিছু জায়গায় এখনও খালের কাজ চলিতেছে । অর্থাৎ নির্মাণজনিত কারণে খালের বুক এখনও পরিস্কার হয় নাই । এই ধরনের খালের কাজ করিতে হয় উচ্চ অববাহিকা অঞ্চল হইতে ক্রমশ নিম্ন অববাহিকার দিকে । সেইদিক হইতে এই খালটাকে কভার্ড করিতে কাজ শুরুর সময়েই গোড়ায় গলদ রাখা হইয়াছে । কাজ শুরু হইয়াছিল মাঝখান হইতে । তাহার পর উচ্চ অববাহিকায় কাজ হয় , বর্তমানে নিম্ন অববাহিকায় কাজ চলিতেছে।
দেখা গিয়াছে এই খাল বাংলাদেশে প্রবেশ করিয়া শস্যখেতে যায় । সেই দেশের কৃষকেরা শুখা মরশুমে এই খালে মরশুমি বাঁধ দিয়া থাকে সবজি চাষের খেতে সেচের জন্য । তাহাদের এই বাঁধ না সরাইলে আগরতলার জল নামিতে পারে না । এই বিষয়েও কোনও তদবির আগে হইয়াছে বলিয়া মনে হয় না । আগরতলার জল নিকাশে গত তিন দশকে যে উন্নতি দেখা গিয়াছে তাহার সকলই হইল পাম্প চালাইয়া জল তুলিয়া হাওড়া কাটাখালে ফেলা । কাটাখালে জল পাঠাইবার জন্য সুইস গেট ব্যবহার হইয়া থাকে । কিন্তু কাটাখালের জল সুইস গেটের অধিক উচ্চতায় চলিয়া গেলে আর জল পাঠানো সম্ভব হয় না । গেট বন্ধ করিয়া দিতে হয় । হাওড়ার নদীবক্ষ বহুকাল আগে হইতেই আগরতলার চাইতেও উপরে রহিয়াছে । নদীতে জল ফেলা হয় পাম্প চালাইয়া । এই আমলে নতুন তিনখানা পাম্প চালু করা হইয়াছে । আগরতলায় এক ঘন্টা টানা বর্ষণে যে পরিমাণ জল দাঁড়ায় তাহা সবকয়টা পাম্প চালু করিয়া তুলিয়া ফেলিতে গেলে পাঁচ ঘন্টা সময় লাগিয়া যায় । তাহা হইলে আগরতলায় বৃষ্টির জলের জলমগ্নতাই থাকিবে না এই প্রতিশ্রুতি দেওয়া যেমন অর্বাচীনসুলভ , তেমনি আগে বৃষ্টির জল দাঁড়াইত এখন তাড়াতাড়ি চলিয়া যায় বলাটাও সত্যের অপলাপ । আগরতলায় জল দাঁড়াইবেই । জল দাঁড়ায় মুম্বাই , দিল্লি সহ দেশের প্রায় সকল নগরেই । কারণ নগর মানেই মাটির সহিত বৃষ্টির দেখা নাই , নগর মানেই নাগরিক আবর্জনা আর কম জায়গার উপর অধিক জনবসতির চাপ । তাই নাগরিক সচেতনতা এইক্ষেত্রে জলমগ্নতা হইতেই বাঁচিবার এক সহজ উপায় । ইহার বাহিরে যাহা হইতে পারে তাহা হইল জলমগ্ন অবস্থায় পারস্পরিক দোষারোপ আর রাস্তার জলে নামিয়া সেলফি তোলা যাইতে পারে মাত্র ।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.