দ্বিতীয় স্বাধীনতার ঢেউ!!
ধর্ম মেশানো রাজনীতি কতটা জটিল ও কুৎসিত হতে পারে, তার সর্বশেষ নিদর্শন সাম্প্রতিক বাংলাদেশের চেয়ে নিশ্চয়ই আর কোন হতে পারে না।তথাকথিত দ্বিতীয় স্বাধীনতার ঢেউয়ে বাংলাদেশ কার্যত এখন উত্তাল।বাংলাদেশের এই পরিস্থিতি একদিনে তৈরি হয়নি।অথচ আজ যখন নৈরাজ্য গোটা দেশকে ঘিরে ধরেছে,তখন পদ্মপাড়ের এই অস্থিরতার জন্য সেদেশের ধর্মীয় উগ্র মৌলবাদীরা পুরো ঘটনায় ভারতের দিকে আঙুল তুলেছে।যে দেশকে স্বাধীন করার জন্য গোটা বিশ্ব জনমতকে একসারিতে দাঁড় করিয়ে ভারত একদিকে তার সেনা আর অপরদিকে অগণিত দেশবাসীর রক্ত ঢেলেছে,আজ সেই জন্মদাত্রী দেশের বিরুদ্ধে উচ্চগ্রামের বিরোধিতার সুর বাজাচ্ছে বাংলাদেশ।
এটা সত্য যে কোটা বিরোধী আন্দোলন সহ আরও একাধিক বেশ কিছু ইস্যুতে উত্তাল ছাত্র আন্দোলনের জেরে গত ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কের রসায়নে বড়সড় পরিবর্তন ঘটেছে। এই বাস্তবতার কথা সম্প্রতি সেদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা তৌফিক হোসেন স্বীকার করে বলেছেন, কূটনৈতিক অবস্থানের দিক থেকে ৫ আগষ্ট পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে একরকম সম্পর্ক ছিল।আর ৫ আগস্টের পর সেই সম্পর্কে বড় বদল ঘটেছে।ঘটনা যা-ই হোক,কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চাপে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর বাংলাদেশ অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। কিন্তু হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশে যে নৈরাজ্য এবং তালিবানি পরিস্থিতির জন্ম হয়েছে গত চার মাসেও তাতে ইতরবিশেষ হেরফের হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান মহম্মদ ইউনুস সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার প্রশ্নে একাধিকবার আশ্বাস দিলেও বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের পরিমাণ বেড়েই চলেছে।বাংলাদেশে হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর ইসলামিক চরমপন্থীদের দ্বারা সংঘটিত নৃশংসতা,হামলা, হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, মহিলাদের উপর নির্যাতন কোনভাবেই বন্ধের জন্য প্রশাসনিক কোন পদক্ষেপ নেই।সর্বশেষ ধিক্কারজনক ঘটনা হলো শনিবার ত্রিপুরা থেকে কলকাতাগামী শ্যামলী পরিবহণের একটি যাত্রীবাহী বাস বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিশ্বরোডে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা। যদিও বাংলাদেশ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে।
এই ঘটনাক্রম সমূহকে ততটা গুরুত্বর দিয়ে মূল্যায়ন করতে নারাজ।সম্প্রতি বাংলাদেশ তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনুসের প্রেস সচিব শফিকুল ইসলাম বলেছেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা নিরাপদে আছেন।কারও কোন সমস্যা হচ্ছে না।বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিভিন্ন প্রচার ও সংবাদ মাধ্যমে বিভ্রান্তিমূলক প্রচার চলছে বলে পাল্টা অভিযোগ করেছেন। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের তরফে পরোক্ষে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো পছন্দ নয় ইউনুস সরকারের।
মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া গণ অভ্যুত্থান বা ছাত্র-বিপ্লব, যে নামেই ঘটনাক্রমকে চিত্রায়িত করা হোক না কেন, আসলে পুরো ঘটনাই ছিল পূর্বপরিকল্পিত। আর তারই সূত্র ধরে নির্বিচারে লুটতরাজ, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের চিহ্নিত করে নির্যাতন সবই একের পর এক ঘটে চললেও বাংলাদেশ সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কোন ভূমিকা নেয়নি। আর এই কথাটাও মনে রাখতে হবে, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার ও নির্যাতনের ঘটনাপ্রবাহকে কোন ভাবেই মিডিয়ার অতিরঞ্জন বা মিডিয়ার অপপ্রচার বলে হাল্কা করা যাবে না। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অধিকার ও উদ্বেগ নিয়ে ভারতের জনগোষ্ঠীর মর্মবেদনা থাকবেই।কারণ বাংলাদেশে বসবাসকারী অন্তত দুই কোটি হিন্দুর যে চার কোটি আত্মীয়পরিজন আমাদের দেশে ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গে, আসাম সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়েছিটিয়ে আছেন, তাদের রক্ত, ঘাম, এপার ওপারের সমস্ত বিধিনিষেধকে উপড়ে ফেলে একাকার হয়ে আছে।মানবাধিকার লঙ্ঘনের একের পর এক সীমাহীন অপরাধকে কোনভাবেই বাংলাদেশ এবং তাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভারতীয় মিডিয়ার অতিরঞ্জন বলে চেপে যেতে পারবে না। কারণ ৫ আগষ্টের ক্ষমতার পালাবদলের দিন থেকেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের ঘটনাগুলোকে সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক অবস্থান দিয়ে শান্ত ও নির্বিষ দেখানোর চেষ্টা হয়েছে।ভাবখানা এ রকম-আওয়ামী লীগকে সমর্থন করার দায়েই তাদের উপর এই অত্যাচার। এখন এই অপকৌশলকে আরও পূর্ণমাত্রায় রূপ দিতে ইসকনকে টেনে আনা হয়েছে। প্রশ্ন হলো ইসকনকে যদি হিন্দুত্বের বাইরে রেখে আলাদা অস্তিত্বের প্রচার করে আওয়ামীর বন্ধু হিসাবে চিহ্নিত করা হয়, তাহলে চট্টগ্রামে রামঠাকুর এবং বাবা লোকনাথের ভক্তদের উপরও আক্রমণ শানানো হচ্ছে কেন?মূল কথা হল, যারা নতুন করে আবার দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস লিখতে চাইছেন, যারা মুক্তিযুদ্ধের এতদিনকার ঘটনাক্রমকে মুছে দিয়ে নিজেদের মতো করে ইতিহাস রচনা করতে চাইছেন তাদের কাছে কোন প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে না। ভারতবিদ্বেষের ইন্ধন জুগিয়ে তারা হয়তো নিজেদের পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে মগজে শান দিচ্ছেন।কিন্তু নিজ নিজ পরিণামের জন্য তার ফল তাকে ভোগ করতেই হবে। প্রসঙ্গক্রমে ২০০৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর কথা স্মরণ করা যেতে পারে আমরা বন্ধু পাল্টাতে পারি, প্রতিবেশী নয়।তাই প্রতিবেশী কতটা সমমর্যাদা ও সম্মান পাবেন সেটা নিজেই তাকে
ঠিক করতে হবে।