এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

অশ্বত্থামা হত ইতি গজ!’ফেথ অব কুম্ভ অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ’-এর মঞ্চে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ মহাকুম্ভের বিশৃঙ্খলা এবং মোক্ষলাভের মোহে পুণ্যার্থীদের মৃত্যুর ঘটনাকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ এবং মৃতদের প্রতি ‘বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি’ জ্ঞাপন করলেও দুঃখপ্রকাশ করেননি, বরং তার সরকারের সূচারু আয়োজনে অন্তত ৫২ কোটি মানুষ স্নান করেছেন, কী ভাবেই বা গঙ্গা, যমুনার অবিরল ধারা বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে থেকে নিজের সরকারের স্তুতির বহর শুনিয়েছেন! দেশের এক-তৃতীয়াংশের বেশি মানুষ নির্দিষ্ট একটি জায়গায় জড়ো হলে পরিস্থিতি কতখানি বিশৃঙ্খল হয়ে উঠতে পারে, কীভাবে সেই বিশৃঙ্খলাকে শৃঙ্খলায় বাঁধতে হয়, তা একান্তই প্রশাসনিক বিষয়। কিন্তু যে ধর্মের মোহে কোটি কোটি মানুষ সঙ্গমে অবগাহন করছেন, তার অন্তনির্হিত দর্শন কী? অবশ্যই ধর্মমোহ। এই মোহ জন্মের কারণ বিবিধ।
‘ধর্মমোহ’ কবিতার প্রথম ছত্রেই কবি লিখেছেন, ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে/অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে।’ ধর্মমোহের মোকাবিলা করতে রবীন্দ্রনাথ ‘বুদ্ধির আলো’ জ্বালানোর, ‘জ্ঞানের আলোক’ আনার আবেদন রেখেছিলেন। ইদানীং রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় শেখানো হচ্ছে, ধর্ম আমাদের দেশে ইতিহাসের দরজা খুলতে সাহায্য করছে। ধর্ম আদপে একটি শক্তিশালী ‘সাইকোট্রপিক’ প্রক্রিয়া যা আমাদের শরীরে সুখানুভূতির হরমোনগুলির নিঃসরণ ঘটায়। জীবন ও জগতের যা কিছু মানুষের বোধবুদ্ধির বাইরে, উপরন্তু তাকে নিয়ত জ্বালাযন্ত্রণা, অনিশ্চয়তা, অস্থিরতায় ভোগায়, ধর্ম সে সবের ব্যাখ্যা দেয়। বিশ্বসংসারের একটা গভীর অন্তর্লীন অর্থ খুঁজে দিয়ে সেখানে মানুষের অবস্থান নির্ধারণ করতে সাহায্য করে। সব রকম সমস্যার মোকাবিলায় ভরসা জোগায়। ধর্মের এই ভূমিকা ব্যক্তিমানুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও। আবেগ আর মনন দু’দিক থেকেই ধর্ম মানুষের বিরাট অবলম্বন, কখনও জাদুশক্তির । সঙ্গে সমন্বিত হয়ে, কখনও দার্শনিক চিন্তার পথ প্রশস্ত করে। সমাজতত্ত্ববিদদের একটি অংশ ধর্মকে গুরুত্বপূর্ণ সমাজবন্ধন হিসেবে দেখেন। একই ধর্মীয় প্রতীকের অংশীদারি করতে গিয়ে অনেক মানুষ একটি ধর্মের ছাতার তলায় ঐক্যবদ্ধ হয়।
মহাকুম্ভের মৃত্যুমিছিল দেখে মনে হয়, মরা আর মারা তো ধর্মের প্রাথমিক ‘ফাংশন’ হতে পারে না, বরং ধর্মের অর্থ বাঁচা আর বাঁচানো। যার প্রাথমিক শর্ত সংবেদনশীলতা, ভালোবাসা, ঔদার্য ও সর্বোপরি নৈতিকতা। সে দিক থেকে কৃষ্ণ-খ্রিস্ট, রাম-রহিম মূলত একই।
সভ্যতার যাত্রার সূচনা হয়েছিল ম্যাজিক থেকে।সেখান থেকে ধর্ম, ধর্ম থেকে বিজ্ঞানের অভিমুখে। কিন্তু গত কয়েক দশক ধরে সেই চলন বিপরীতমুখী। বিজ্ঞানের অভিমুখ থেকে এখন দুনিয়া জুড়ে ধর্মের পুনরুজ্জীবন। কারণ মানুষের অসহায়তা, অনিশ্চয়তা, জীবনযন্ত্রণা অব্যাহত। ধর্মে চলন আবার আধিপত্য-অভিমুখী। ধর্ম যেমন সমাজবন্ধনের কাজ করে, তেমনই মানুষকে সঙ্কীর্ণ অস্মিতার বাক্সে বন্দি করে অপরায়ণের হাতিয়ারও হয়ে ওঠে। তাই ধর্মের নামে হানাহানি ইতিহাসে কম হয়নি – বিভিন্ন ধর্ম, এমনকী একই ধর্মের ভিতরেও। হিন্দু-মুসলমান, মুসলমান-খ্রিস্টান, শৈব-বৌদ্ধ, শাক্ত-বৈষ্ণব, শিয়া-সুন্নি উদাহরণ সুপরিচিত। ইউক্যারিস্ট অর্থাৎ গির্জায় বিতরিত রুটি আর মদ সত্যি যীশুর মাংস আর রক্ত কি না, এমন বিষয়কে কেন্দ্র করে একদা ইউরোপে রক্তগঙ্গা বয়েছে।
তাই সাইকোট্রপি হিসেবে ধর্মের ভূমিকাও জটিল, যাকে আরও জটিল করে তোলে ধর্মের নিয়ন্ত্রক তথা শাসকবর্গ। শ্রেণীবিভাজিত বৈষম্যভিত্তিক সমাজের শাসকরা মানুষের মনে ধর্মমোহ জাগিয়ে নিজেদের ক্ষমতা সুরক্ষিত করে। কথাটা সর্বকালে, সর্বদেশে সত্যি সে রাজতন্ত্রই হোক বা গণতন্ত্র। শাসকশ্রেণীর পোষিত ধর্মে শামিল হয়ে বঞ্চনা-নিপীড়নকে সহ্য করে নেয় মানুষ। তাই যে কালো মানুষদের ক্রীতদাস বানিয়ে পীড়ন করা হয়, তাদের আবার খ্রিস্টীয় ভগবানের ভক্তও করে তোলা হয়। এ সবই হলো সাইকোট্রপির খেলা। এ দেশে প্রান্তিক জনজাতিদের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি ভাবলে ভুল হয় না।
অল্ডাস হাক্সলির ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড-এ এক রাজ্যের কথা আছে, যেখানে শাসকরা ল্যাবে শিশু উৎপাদন করে, তারপর তাদের মগজধোলাই করে, আর দেদার বিতরণ করে এক ড্রাগ, যা মানুষকে বোঝায় তারা কত সুখী! এই ভাবে আলফা-বিটা-গামা ইত্যাদি শ্রেণীতে বিভক্ত সমাজকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে শাসকের সুবিধা হয়। আজকে আমাদের দেশে শাসকরা ধর্মকে ব্যবহার করছেন এ রকমই মাদকদ্রব্যের মতো। গরিষ্ঠ মানুষেরও শারীর-রসায়নে ঘটে গেছে বিরাট উদ্দীপনার সঞ্চার! কিন্তু মজার কথা, রাজনীতি বা সমাজে কোন প্রতিপক্ষই এই চালাকিটা অনাবৃত করে তাকে পাল্টা চ্যালেঞ্জ করার সাহস দেখাচ্ছে না। ধর্মমোহ এমনই জাদু, যাকে মোহমদগর ভাঙতে পারে না।

Dainik Digital

Share
Published by
Dainik Digital

Recent Posts

১০০ ও ২০০ টাকার নোট নিয়ে নয়া নির্দেশ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-১০০ এবং ২০০ টাকার নোটের বিষয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বড়সড় সিদ্ধান্ত।সোমবার জারি করা এক…

59 mins ago

আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আগুন!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-আচমকাই আগুন লাগে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে । সোমবার সন্ধ্যায় আগুন…

7 hours ago

সিন্ধু তীরের জলযুদ্ধ!!

পহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসী হানার একদিন পরে বৃহস্পতিবার ভারতের জলসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব দেবশ্রী মুখার্জি পাকিস্তানের জলসম্পদ মন্ত্রণালয়ের…

1 day ago

বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর অপরাধে নিষিদ্ধ করা হল ১৬ টি ইউটিউব চ্যানেল!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-পহেলগাঁও হামলার পর থেকে কেন্দ্রীয় সরকার অ্যাকশন মোড অন করেছে । সোমবার কেন্দ্রীয়…

1 day ago

পুনরুজ্জীবনের স্বপ্ন অপূর্ণই জুটমিল এখন ভূতুড়ে বাড়ি!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-রাজ্যবাসীর যে স্বপ্ন নিয়ে আশির দশকে গড়ে উঠেছিল রাজ্যের বৃহৎ -মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান…

1 day ago

কাঞ্চনপুরে ভুট্টার রেকর্ড উৎপাদন, বাজারে বিক্রি নেই হতাশায় কৃষক!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-খরিফ মৌসুমে কাঞ্চনপুর মহকুমার বিভিন্ন কৃষি অঞ্চল জুড়ে ভুট্টা উৎপাদন অতীতের সব রেকর্ড…

1 day ago