এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

একাধিক গুরুত্বপূর্ণ রায় ও মন্তব্যের সূত্র ধরে কলকাতা হাইকোর্টের অতি চর্চিত এবং অবশ্যই সাধারণ্যে জনপ্রিয় বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় সর্ব অর্থেই এক ব্যতিক্রমী চরিত্র।বিচারপতির গৌরবোজ্জ্বল পদ থেকে সময়ের পূর্বে আকস্মিক অবসর নিয়ে,তার অব্যবহিত পরেই ভারতীয় জনতা পার্টিতে যোগ দিয়েছেন এবং পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার হলদিয়া শিল্পতালুকে সমৃদ্ধ তমলুক লোকসভা আসনে পদ্মপ্রার্থী হয়েছেন। স্বভাবতই এই ঘটনা নানা কারণে জনপরিসরে কিছু উত্তেজনার সঞ্চার করেছে। কারণ প্রথমত,তিনি বিচারপতির আসন ছেড়ে দলীয় পতাকা হাতে তুলে নিয়েছেন।দ্বিতীয়ত,এমন এক বিন্যস্ত চিত্রনাট্য রচনা করে, দক্ষ শিল্পীর মতো সেই চিত্রনাট্যের রূপদান করেছেন। তৃতীয়ত, তথা সর্বোপরি, দীর্ঘ সময় জুড়ে বিচারপতির আসনে তার ভূমিকা, বিশেষত তার বিবিধ মন্তব্যের ভাষা ও ভঙ্গি, বহু নাগরিকের মনে তার সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল।
তবে এগুলির কোনওটিই মৌলিক প্রশ্ন নয়।ব্যক্তি এখানে গৌণ।মুখ্য প্রশ্নটি একমাত্র নীতি তথা নৈতিকতার।এমনিতে বিচারপতির আসন ছেড়ে দলীয় রাজনীতিতে নাম লেখানোয় আইনগত কোনও বাধা নেই, এমনকি দুই পর্বের মধ্যে একটা ন্যূনতম সময়ের ব্যবধান রাখারও আইনি বাধ্যবাধকতা নেই, কথাগুলি সদ্য- প্রাক্তন বিচারপতি নিজেই সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন।এমনকি এই প্রশ্ন যারা তুলছেন,তাদের আইনের বই পড়ে আসার পরামর্শ দিতেও দ্বিধা করেননি।এখানেই প্রশ্ন। একজন বিচারপতি বিলক্ষণ জানেন যে, আইনের ধারা দেখিয়ে নৈতিকতার বিচার হয় না। প্রশ্নটি স্বাভাবিক বিবেচনাবোধের।বিচারপতি সমাজের চোখে কেবল সম্মানের পাত্র নন,নৈতিক আদর্শের পরাকাষ্ঠা হিসাবে তার ভূমিকা সংশয়োর্ধ্ব থাকাই কাম্য।
বর্তমান ভারতে আদালতের এই গুরুত্ব ক্রমবর্ধমান। শাসনবিভাগের আধিপত্যবাদ এবং আইনবিভাগের নিষ্ক্রিয়তার প্রেক্ষাপটে বহু মানুষের কাছে আজ বিচারবিভাগই গণতান্ত্রিক নীতি ও আদর্শের পরম আশ্রয়।

অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের আকস্মিক পর্বান্তরে সেই গুরুত্বের শর্ত লঙ্ঘিত হল কিনা সেটিও অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বিশেষত,বিচারপতির আসনে বসে তিনি যে ভাষায় ক্রমাগত শাসক শিবিরকে তিরস্কার করতেন এবং সতর্কবাণী প্রচার করতেন, এমনকি বঙ্গের শিক্ষা সংক্রান্ত মামলায় রাহুল গান্ধীর সম্পত্তির হিসাব চাওয়ার কথা বলেছিলেন, তার ফলে এমন সন্দেহ গাঢ়তর হওয়ার যথেষ্ট অবকাশ থাকে। বিচারপতিদের সম্পর্কে এই ধরনের সংশয়ের লেশমাত্র থাকা বাঞ্ছনীয় নয়, অথচ আক্ষেপের বিষয় এ দেশে মাঝে মধ্যেই তেমন সংশয় তৈরি হয়।অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এই আবহে নতুন সংযোজন বললে অত্যুক্তি হয় না। কাল পর্যন্ত যিনি উচ্চ আদালতে সংবিধানের রক্ষাকবচ হিসাবে বিচার করেছেন,তিনি পদত্যাগ করেই একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হলে বিবিধ প্রশ্নের উদ্রেক হওয়াই স্বাভাবিক।
অধিকাংশ বিচারকই হায়ার জুডিশিয়াল সার্ভিস বাদ দিলে সাধারণত অভিজ্ঞ আইনজীবীদের মধ্যে থেকে নিযুক্ত হন।অনেকেরই কোনও না কোনও রাজনৈতিক দল বা মতাদর্শের প্রতি নৈতিক সমর্থন থাকতেই পারে।কিন্তু বিচারক পদে আসীন হওয়ার পর থেকে তিনি নিজেকে দলীয় রাজনীতি,বা পূর্বের রাজনৈতিক জীবনের সহকর্মী, এমনকি সামাজিক মেলামেশা থেকে বিরত রাখবেন সেটাই কাঙিক্ষত। বিচারপতিদের ইংরেজ শাসনকাল থেকে ‘ধর্মাবতার’ সম্বোধন করা হয়ে থাকে।এর মূলে রয়েছে এই বিশ্বাস যে, বিধাতার মতোই বিচারকেরা নিরপেক্ষ বিচার করেন। কিন্তু সেই বিচারক, বিচারপতিরা যদি মেয়াদের আগেই পদ ছেড়ে রাজনৈতিক দলে যোগ দেন, প্রার্থী হয়ে ভোটযুদ্ধে শামিল হন, সেক্ষেত্রে সামাজিক মূল্যবোধ কোথায় দাঁড়ায়?
তবে এই একরৈখিক অভিমতের বিরুদ্ধ-মতটিও সমধিক গুরুত্বপূর্ণ।অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের হিসাবের পূর্বাপর কার্যকলাপে অসঙ্গতি খোঁজা হবে, সেখানে হয়তো বিদ্রূপও থাকবে, কিন্তু পাশাপাশি থাকবে নতুন দিশাও। জ্ঞানী, গুণী, কৃতবিদ্য সুধীজনেরা রাজনীতিতে এলে রাজনীতিরই মঙ্গল।শিল্প বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ, বৈজ্ঞানিক, অন্যান্য কুশলী মানুষের সহযোগ রাজনীতি বিভিন্ন উচ্চতায় স্থাপিত হতে পারে।সেই ঝুঁকিসস্কুল পথের পথিক হওয়ার সাহস ও যোগ্যতা সবার থাকে না, অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের রয়েছে।দেশ ও সমাজের এই কালবেলায় তার অংশগ্রহণ এক বেনজির দৃষ্টান্ত, যা হতে পারে এক দেশপ্রেমিকের স্বাভাবিক বিবেচনার বোধ। তবে কী, যাকে উদ্দেশ করে শতকন্ঠ বারংবার ‘ধর্মাবতার’ সম্বোধন করেছে, দিনাবসানে তিনিও চিরাচরিত রাজনীতির গড্ডলে গা ভাসিয়ে দিলে সম্মার্জনীয় সেই পদটি সম্পর্কে সমাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য।

Dainik Digital

Share
Published by
Dainik Digital

Recent Posts

নিজেদের অধিকার রক্ষায় বৈঠকে যাচ্ছে টিএফএর আজীবন সদস্যরা।।

অনলাইন প্রতিনিধি :-রাজ্য ফুটবলের অভিভাবক সংস্থা টিএফএর সংবিধান সংশোধন করার নামে নিজেদের অধিকার কেড়ে নেওয়ার…

14 mins ago

এডিসির ৩০২ স্কুলে ১ জন করে শিক্ষক, ছাত্র সমস্যা নিরসনে সরকার আন্তরিক, বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী।।

অনলাইন প্রতিনিধি :-এডিসির ৩০২ টি স্কুলে শিক্ষক ১ রয়েছে।জাতীয় স্তরে প্রাথমিক স্কুলে ছাত্র- শিক্ষকের অনুপাত…

23 mins ago

কাজ করেনি,ফেরত গেছে ২২.৯১ কোটি টাকা,বাম আমলে অন্ধকারে ডুবে ছিল রাজ্যের পর্যটন: সুশান্ত।।

অনলাইন প্রতিনিধি :-বামফ্রন্টের টানা ২৫ বছরে রাজ্যের পর্যটন শিল্পের কোনও উন্নয়নই হয়নি। সম্পূর্ণ অন্ধকারে ডুবে…

35 mins ago

জাল ওষুধের রমরমা।

একা রামে রক্ষা নেই, সুগ্রীব দোসর। কথাটা বোধহয় এক্ষেত্রে একেবারে যথার্থভাবে ধ্বনিত হয়।গত কয়দিন ধরেই…

1 hour ago

রাজ্যের সম্পদ ব্যবহারে রিলায়েন্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে: মুখ্যমন্ত্রী!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-রিলায়েন্স গ্রুপ রাজ্যের প্রাকৃতিক সম্পদগুলি ব্যবহারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। মঙ্গলবার বিধানসভায়…

1 hour ago

হৃদরোগে হঠাৎ মৃত্যু: কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের কারণ, লক্ষণ, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-বর্তমান যুগে হৃদরোগ জনিত সমস্যা ক্রমশ বেড়ে চলেছে।এর মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক ও জীবনঘাতী…

1 day ago