ধর্ম থাক হিতার্থে
অনলাইন প্রতিনিধি :- হিন্দুধর্মের যে পাঁচটি মৌলিক দার্শনিক ধারনার কথা বলা হয়েছে, তার পঞ্চমটি হল, ‘বহুজনের কল্যাণ, বহুজনের সুখ’। সংস্কৃতে এটাই বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে গৌতম বুদ্ধ তার শিষ্যদের বেদের এই সূত্র অনুসরণ করে সাধারণ মানুষের কল্যাণও সুখের জন্য কাজ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সংস্কৃত ধূ ধাতু থেকে ধর্ম শব্দের উদ্ভব। ধৃ অর্থাৎ ধারণ করা। অতএব ধর্ম যদি হয় বহুজন হিতায়, তার চাইতে উত্তম কিছু নেই। রবীন্দ্রনাথ ‘মানুষের ধর্ম’ বক্তৃতামালায় বলছেন, ‘বাইরে আছে নানা দেশের নানা সমাজের নানা জাত, অন্তরে আছে এক মানব’। প্রসঙ্গের অবতারণার কারণে, কাশীর জ্ঞানবাপী মসজিদের তেহখানায় (পাতালঘর) হিন্দুদের পুজো করার অধিকারের পক্ষে এলাহাবাদ হাইকোর্টের সাম্প্রতিক রায়।
এর আগে ওই তেহখানায় হিন্দুদের পুজো করার অধিকারের পক্ষে রায় দিয়েছিল জেলা আদালত। ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেছিল জ্ঞানবাপী মসজিদ কমিটি। কিন্তু হাইকোর্টের বিচারপতি রোহিতরঞ্জন আগরওয়ালের বেঞ্চ জানিয়েছে, প্রাথমিক ভাবে জেলা আদালতের রায়ে হস্তক্ষেপ করার কোনও কারণ নেই। হাইকোর্ট তার পর্যবেক্ষণে বলেছেন, মসজিদের দক্ষিণের তেহখানায় পুজো করার আন্তর্বর্তী নির্দেশ মুসলিমদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ নয়।বস্তুতই এই রায়কে সংখ্যালঘুর উপর সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদ কায়েম হিসাবে দেখা ঠিক নয়। পক্ষান্তরে এই রায়ের সূত্র ধরে ইতি প্রতিপক্ষের গাত্রদাহের উদ্রেক হয় তেমন ঢক্কানিনাদও কাম্য নয়। আমাদের স্মরণে রাখতে হবে, হিন্দু সভ্যতা বহুত্ব ও বৈচিত্রের ফসল।
এই সভ্যতা তথা সংস্কৃতির মানবিক একাত্মবোধ আমাদের নাগালের যতখানি নিকটে, অন্য সব সভ্যতার ততখানি নাও হতে পারে। হিন্দু চেতনা বিভিন্ন রিলিজনের উপাদান আত্মস্থ করে সেগুলিকে এবং নিজেকে সমৃদ্ধ করতে পারে। বিবেকানন্দ বলেছেন, বেদান্তের দ্বৈতবাদের রূপান্তর আব্রাহামীয় ধর্মগুলিতে, আবার বৌদ্ধধর্ম প্রভৃতিতে তা অদ্বৈতবাদের রূপান্তর। তাই রামচন্দ্রকে আমরা বলতে পারি, ‘ঈশ্বর আল্লা তেরা নাম’: তাতে রামচন্দ্রের মহত্ব আরও পরিস্ফুট হয়, সব খণ্ডতত্ত্ব মিলে যায় তাঁর পরিপূর্ণ সত্তায়। এই ঔদার্য, এই সামগ্রিকতা হিন্দু কৃষ্টির অনন্য মহান শক্তি। সেল কৃষ্টিাকে একটা বিশেষ সঙ্কীর্ণ প্রকাশে বেঁধে ফেললে, মনুষ্যত্বের ধর্মাসন থেকে নামিয়ে প্রাপ্তবিশ্বাসের আখড়ায় মল্লল্লযুদ্ধ করতে পাঠালো তার ঐতিহ্যকে অপমান করা হয়।
জনান্তিকে যথার্থ বলছেন বিবেকানন্দ- ‘হিন্দুধর্ম তো শিখাইতেছেন- জগতে যত প্রাণী আছে সকলেই তোমার আত্মারই বহু রূপ মাত্র। সমাজের এই হীনাবস্থা কারণ, কেবল এই তত্ত্বকে কার্যে পরিণত না করা, সহানুভূতির অভাব হৃদয়ের ‘অভাব’। এখানে উল্লেখনীয়, সহানুভূতি বলতে স্বামীজি নিছক মায়া বা অনুকম্পা বোঝাচ্ছেন না, বোঝাচ্ছেন সহ-অনুভূতি সহমর্মিতা, হৎস্পন্দনে ‘অপর’-কে, ‘একা বঙ্গে গণ্য করা। আজ জ্ঞানবাপী অথবা আগামীকাল মথুরার শাহি ইদ্গা, আদালতের রায় সংখ্যাগুরুর পক্ষে গেলেও সেই আবেগে যেন বিরোধ, বর্জন ও সহিংস দমনের পথ থেকে সকলে বিরত থাকেন। ধর্মাচরণ থাক অন্তরে সেটাই সুস্থ আচার বা সংস্কৃতির পরিচায়ক। ধর্ম একটি বিশ্বাস, যা প্রত্যেকের ক্ষেত্রে বিভিন্ন হতে পারে।
মহাকাব্য রামায়ণের চরিত্র নিয়ে যে উৎসাহ উদ্দীপনা সামনে এসেছে, তা যে কোনও সম্প্রদায়ের কাছে গর্বের বস্তু, তাদের নিজস্ব অস্মিতার পরাকাষ্ঠা হতে পারে। তবে ধর্মের মূল কথা ত্যাগ, দুঃখ সহ্য করার সাহস, তা রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন ‘গান্ধারীর আবেদন’ কাব্যে। গান্ধারী তার স্বামী ধৃতরাষ্ট্রকে বলেন ধর্মকে রক্ষা করতে হলে প্রিয় পুত্র দুর্যোধনকে ত্যাগ করতে হবে। মন্দির হোক বা মসজিদ-গির্জা, তা যেন পারস্পরিক বিভেদ সৃষ্টি না করে, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান যাতে নষ্ট না হয়। মরা আর মারা ধর্মের প্রাথমিক ‘ফাংশন’ নয়, বরং তা হলো বাঁচা আর বাঁচানো, যার জন চাই সংবেদনশীলতা, ভালোবাসা, ঔদার্য আর সে সবের সঙ্গে জড়িত নৈতিকতা। বস্তুত এটাই বহুজন হিতায়। ভুললে চলে না, ধর্ম যেমন সমাজবন্ধ কাজ করে, তেমনই মানুষকে সঙ্কীর্ণ অস্মিতার বাক্সে বন্দি – করে অপরায়ণের হাতিয়ারও। ও হয়ে উঠে। ধর্ম বলতে বুঝতে হবে গভী চিন্তারর পথে পাওয়া জীবনবোধকে। ধর্ম আসলে একটা ‘ইন্টেলেকচুয়াল এক্সারসাইজ’ বোধ ও বুদ্ধির চর্চা। ধর্ম মানে সব চিন্তাভাবনার পথ বন্ধ করে দেওয়ার বন্দোবস্ত নয়।