ধাক্কা খেল সুরক্ষা

 ধাক্কা খেল সুরক্ষা
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

ভারতের সাম্প্রতিক কালের ইতিহাসে খুব সম্ভবত ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনার নজির হয়ে রইল শুক্রবার সন্ধ্যায় ওড়িশার বালেশ্বরে অভিশপ্ত বিপর্যয়। শুধুমাত্র আহত ও নিহতের পরিসংখ্যানে নয়,যে ব্যাপকতা ও ভয়াবহতা এই রেল দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে সামনে এসেছে, তা অতীতের যে কোনও বীভৎসতা ও দুঃসহ যন্ত্রণার চেয়ে কোনও অংশে কম নয়।কারণ প্রথমে দাঁড়িয়ে থাকা একটা পণ্যবাহী ট্রেনকে ধাক্কা মারে করমণ্ডল এক্সপ্রেস।ঠিক একই সময়ে পাশের রেললাইন দিয়ে যাওয়ার সময় যশবন্তপুর এক্সপ্রেসও করমণ্ডল এক্সপ্রেসকে ধাক্কা মেরে লাইনচ্যুত হয়ে যায়। দুর্ঘটনার প্রায় চব্বিশ ঘন্টা অতিক্রান্ত হতে চললেও ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে এখনও একের পর এক দেহ বেরিয়ে আসার ফলে মৃত্যুর মিছিল কোথায় গিয়ে থামবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। ইতিমধ্যেই এই দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত ২৯০ জন নিহত হয়েছেন। আহতের সংখ্যা প্রায় ৯০০ ছাড়িয়ে গেছে। এত বড় বিপর্যয়ের পর কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রক দুর্ঘটনার উচ্চপর্যায়ের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। দুর্ঘটনার রাতেই ঘটনাস্থলে পৌঁছেছেন রেলমন্ত্রী। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় চলছে এখনও উদ্ধারকার্য।এনডিআরএফ,সেনা সহ আকাশপথে হেলিকপ্টারকে নামানো হয়েছে নজরদারির কাজে।ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে দুর্ঘটনা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে।প্রধানমন্ত্রী নিজে দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছেছেন।কীভাবে এত বড় বিপর্যয় হয়ে গেছে বৈঠকে তা নিয়েও পর্যালোচনা হয়।রেলমন্ত্রক এবং প্রধানমন্ত্রীর বিপর্যয় ত্রাণ তহবিল থেকে দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতদের পরিবারকে সাহায্য ও ক্ষতিপূরণের ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে।পশ্চিমবঙ্গ সরকারও আলাদা করে একই সাহায্যের কথা জানিয়েছে।আর্থিক অনুদান বা পরিবারটিকে সাহায্য দিয়ে কোনও মৃত্যুরই ক্ষতিপূরণ করা যায় না।কিন্তু বিপর্যয়ের মুহূর্তে নিহত কিংবা আহতদের পরিবারটির পাশে দাঁড়ানোর জন্য রাষ্ট্র আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে থাকে।কিন্তু আর্থিক সাহায্য দিয়েই সরকার এতবড় দুর্ঘটনার দায় থেকে নিজেকে আড়াল করতে পারবে না।যদিও এই ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনার কারণ উচ্চপর্যায়ের তদন্তের মাধ্যমে প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত এখনই এই সম্পর্কে কোনও দোষারোপ বা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো ঠিক হবে না। কিংবা এই দুর্ঘটনার বিষয়টির সঙ্গে রাজনীতিকেও একই সারিতে এনে দাঁড় করানো কাম্য নয়। কিন্তু একটা বিষয় এখনই নির্দ্বিধায় বলা যায় রেলের বিরাট গাফিলতির কারণেই একইসঙ্গে একই স্টেশনে তিনটি ট্রেন দুর্ঘটনায় পড়েছে।দুর্ঘটনার পর কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রক ও কেন্দ্রীয় সরকারের কিছু কাজকর্ম নিয়ে অভিযোগ সামনে আসতে শুরু করেছে।যেমন, গত বছর মার্চ মাসে রেলমন্ত্রক ট্রেন দুর্ঘটনা প্রতিরোধী অটোমেটিক ট্রেন প্রোটেকশন সিস্টেম চালু করেছিল।এই সিস্টেমটি হলো এমন এক প্রক্রিয়া,যেখানে লোকোমোটিভ ড্রাইভাররা সিগন্যাল মিস করলে কিংবা ট্রেনের গতিবেগ নিয়ন্ত্রণের দরকার হলে অথবা দৃশ্যমানতা কম থাকলেও নিরাপদে ট্রেন নিয়ে যেতে সক্ষম এই কবচ সিস্টেম।চালক ভুল করলেও এই স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় অটোমেটিক ট্রেন প্রোটেকশন সিস্টেম সামাল দিতে পারে পুরো ব্যবস্থা।কিন্তু অভিযোগ হলো,গতকাল যে রেলরুটে এই দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে সেখানে এই ব্যবস্থা চালু হয়নি।অভিযোগ উঠেছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকাকালে রেলের নিরাপত্তার জন্য যে অ্যান্টি কলিসন ডিভাইস সিস্টেম চালু করেছিলেন, বর্তমান সরকার সেটা অবজ্ঞা করে গেছে।পরিবর্তে সরকার অটোমেটিক ট্রেন প্রোটেকশন সিস্টেম চালুর কথা বললেও সেটাও যথাযথ করা হয়নি। ভারতে মোট রেল রুটের দৈর্ঘ্য ৬৮,০৪৩ কিলোমিটার।অথচ কেন্দ্রের মোদি সরকার এই পর্যন্ত মাত্র ১৪৪৫ কিলোমিটার রেল রুটে এই ডিভাইস সিস্টেম কার্যকর করেছে।অর্থাৎ দেশের মূল রেললাইনের মাত্র ২ শতাংশ জুড়ে এই ডিভাইস বসানো হয়েছে এবং বাকি ৯৮ শতাংশ রেল রুট ডিভাইসহীন নিরাপত্তাহীনতায় চলছে। স্বাভাবিক কারণেই বিরোধীদের তরফে এবার অভিযোগের তির ধেয়ে আসবে সরকারের বিরুদ্ধে। এটা আশ্চর্যের কিছু নয়।কারণ সরকার একদিকে মুখে ত্মনির্ভর ভারতের কথা বলছে।২০২২ সালের দেশের বাজেটে এই ভিভাইস সিস্টেমের কথা ঘোষণা করেছে। কিন্তু বাস্তবে দেশে ভিভাইস আছে মাত্র ২ শতাংশ রেলরুটে।নিরাপত্তা ও সুরক্ষা যে কোন ও পরিষেবার মূল কথা। একদিকে সরকার পৃথক রেল বাজেটের পরিবর্তে রেলকে মূল বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করেছে। ইতিমধ্যেই বেশ স্টেশন ও রেল পরিষেবা বেসরকারীকরণের দিকে ঝুঁকছে কেন্দ্র।অথচ যাত্রী নিরাপত্তা নিয়ে সরকারের সচেতনতা ও সংবেদনশী শুধুই কথার কথা,শুক্রবারের ভয়াবহ বিপর্যয় সেই প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসেছে।রেলের সিগন্যালিং এবং সেফটি সিস্টেমকে যথাযথ গুরুত্ব না দিয়ে দ্রুতগতির বিলাসবহুল নতুন ট্রেন চালু করার ঝোঁক যা বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে দেখা যাচ্ছে তা শুধরে নিয়ে মানুষের জীবন এবং যাতায়াতকে নিষ্কন্টক করাই হবে এই বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকারের আগামী পথচলার রোডম্যাপ। প্রযুক্তিগত ত্রুটি,মানুষের ভুল নাকি সরকারের উদাসীনতায় এতগুলো মানুষের প্রাণহানি হয়েছে— দেশের মানুষ এই সত্যটা জানতে চায়।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.