ধ্বংস এবং পুনর্নির্মাণ!!

 ধ্বংস এবং পুনর্নির্মাণ!!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

ত্রিপুরার বন্যা পরিস্থিতি অভাবনীয় এবং পূর্বে এই রকম পরিস্থিতি একখনোই তৈয়ার হয় নাই।এতো সংখ্যক মানুষের জীবনে কখনও একসঙ্গে বিপর্যয় নামিয়া আসিবার ইতিহাস নাই।তাই এই পরিস্থিতি হইতে উত্তরণ কীভাবে ঘটিবে তাহা লইয়া আগাম কিছু অনুমান করা সম্ভব হইতেছে না।তবে সকলেই বুঝিতেছে এই কাজ বড়ই কঠিন।উত্তরণের পথ খুঁজিতে হইবে সকলে মিলিয়া।বন্যার করাল গ্রাসে দক্ষিণ জেলা,গোমতী এবং সিপাহিজলা জেলার একটি বড় অংশের কৃষি নিশ্চিহ্ন হইয়াছে।আমন ফসলের প্রভূত ক্ষতির পর এই সকল কৃষি ক্ষেতে রবি শস্য চাষ আদৌ সম্ভব হইবে কিনা তাহা বলা কঠিন। এক কথায় ত্রিপুরার মোট চাষ জমির একটি বড় অংশ পতিত পড়িয়া থাকিবে দীর্ঘ সময় ধরিয়া।
কৃষিজমির চাইতে খারাপ অবস্থায় রহিয়াছে কৃষকের বাসস্থান।মাটির ঘর মাটিতে মিশিয়া গিয়াছে।পাকা ঘরের মেঝে কেবল নহে,কারও ক্লারও খাট পালঙ্ক অবধি পলিতে ঢাকিয়া গিয়াছে। বিছানাপত্র যাহা ছিল সকলই আছে কিন্তু ব্যবহারের অযোগ্য।এক কৃষকের সংসারে নিড়ানি-কাস্তে হইতে শুরু করিয়া তাহার কাঁথা কম্বল বালিশ সকলই নষ্ট হইয়াছে।আমনের জন্য যে ঋণ করিতে হইয়াছিল সেই আমন ধান তো সূর্যের আলো দেখিল না,ঋণের টাকা জলেই গেলো।সেই টাকা শোধ দিবার উপায় খুঁজিতে শিবিরবাসী কৃষক এইবার শূন্য দৃষ্টিতে আকাশ দেখা ছাড়া আর কিছু করিতে পারিতেছে না।এই সময়ে মাঠে পুনর্বাসন লইয়া নামিবে সরকার।আর এর পূর্বে আপৎকালীন সময়ে মানবিকতার ছোঁয়ায় মানুষগুলিকে জাগাইয়া রাখিতে মাঠে রহিয়াছেন সহনাগরিকেরা।সহনাগরিকদের এই আপ্রাণ চেষ্টা এবং আকুতি অন্য অন্য রাজ্যে বিরল।ত্রিপুরার মানুষের হৃদয়বত্তা সেই জন্য সর্বকালেই মানবিকতার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হইয়া সামনে আসিয়াছে,অতীতেও এবং আজ বর্তমানেও।কিন্তু এই মানবিকতা যতটা মানসিক, মনোজাগতিক ততটা বস্তুগত নহে। হওয়া সম্ভবও নহে। সাধসাধ্যের লড়াই এইখানে থাকিয়াই যায়।মানুষ চাহিলেই সহায়তায় পাশে আসিয়া দাঁড়াইতে পারিবে এমন নহে।বন্যার্ত মানুষের যে পরিমাণ ক্ষতি হইয়াছে সেই ক্ষতির ক্ষতিপূরণ দিবার আর্থিক সঙ্গতি নাই সহনাগরিকের একক বা যৌথ কোনও উদ্যোগেই।অর্থ এই ক্ষেত্রে একটি বাধা হইয়া দাঁড়ায়।ফলে আজ বন্যার্ত মানুষের জন্য যেই ব্যথা যন্ত্রণা দেখা যাইতেছে সহনাগরিকের হৃদয়ে তাহা থাকিয়া গেলেও ধীরে ধীরে কমিয়া যাইবে ত্রাণ সহায়তা।
সেই ক্ষেত্রে সরকারকে ময়দানে নামিয়া আসল কাজটি শুরু করিতে হইবে। এই কথা সকলেই স্বীকার করিবে এতো বড় বিপর্যয় সামলাইবার অভিজ্ঞতা এই প্রশাসনের নাই।তাহা ছাড়া মাঠ স্তরে যে কাজ করিতে হইবে তাহার জন্য সরকারের পরিকাঠামো হইলো ত্রিস্তর পঞ্চায়েত।সরকারী কোনও প্রকল্পকে সফল করিবার জন্য ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের কোনও বিকল্প আজ অবধি দুইটি নাই।অন্য কোনও রকম সরকারী কমিটিই অতীতে এতো সুফলদায়ী হইতে পারে নাই।কারণ নির্বাচিত পঞ্চায়েত বরাবর মানুষের কাছে উত্তরদায়ী থাকিয়া যায়।বেনিফিসিয়ারি নির্বাচন হইতে শুরু করিয়া সকল কাজ জনসমক্ষে স্বচ্ছতার সহিত করিবার প্রথা রহিয়াছে এই আইনে।কিন্তু পরিতাপের বিষয় হইলো রাজ্যে এই সময়ে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত রুগ্ন অবস্থায় রহিয়াছে।
রাজ্যে এক অসুস্থ রাজনৈতিক আবহের কারণে এই পরিণতি।রোগের হিস্ট্রি দেখিতে হইলে দেখা যাইবে অসুখটা গোড়া হইতেই রহিয়াছে।তবে এই সময়ে বড় তীব্র।৮০/৯০ শতাংশ পঞ্চায়েত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মীমাংসা হইবার অর্থ হইতেছে রাজনৈতিক পরিবেশ সুস্থ নহে।এই অসুস্থতার সাইড এফেক্ট এখন বড় হইয়া সামনে আসিতেছে।শপথ লইয়া গ্রামে গ্রামে যে স্বদলীয় মারামারি হইতেছে ইহা সেই অসুস্থতার লক্ষণ।প্রতিপক্ষ দলের কাউকে পাইতেছে না বলিয়া স্বদলীয় লোককেই মারধর করা হইতেছে। আক্ষেপের বিষয় হইলো যাহারা মারামারি করিতেছে তাহাদের মধ্যে বন্যার্ত মানুষও রহিয়াছে।তাহারা বন্যাত্রাণের, পুনর্বাসনের মতন একটি বৃহৎ মানবিক কাজে যাইবার আগে দধি-শক্করে রক্তারক্তি করিয়া লইতেছে।প্রভাতের সূর্যই নাকি দিনের আভাস দিয়া থাকে।এই লোকেরা যাহারা জনগণের ভোটে প্রতিনিধি হয় নাই,হইয়াছে পেশীর জোরে তাহারা কোনওভাবেই জনগণের নিকট দায়বদ্ধ হইতে পারে না।ইহা ত্রিস্তর পঞ্চায়েতরাজ আইনের যে স্পিরিট বা ভাবনা তাহার বিপরীতের বিষয়।
কাহারো মনে প্রশ্ন উদয় হইতে পারে,এই সকল ঘটনা কি আগের আমলে ছিল না? তাহাদের জন্য একটা প্রহসন শুনানো যাইতে পারে। মহাভারতের রাজসভায় দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ পর্বে পিতামহ ভীষ্ম নাকি উঠিয়া দাঁড়াইয়া প্রতিবাদ করিতে চাহিয়াছিলেন।এমন সময় পাশের একজন সভাসদ নিচুস্বরে তাহাকে সম্বোধন করিয়া বলিয়াছিলেন, রামায়ণে সীতা অপহরণের সময় আপনি কী করিতেছিলেন?ইহার পরের ইতিহাস সকলেরই জানা। ত্রিপুরায় পঞ্চায়েত ব্যবস্থার এই অসুস্থতা এই সময়ে সবচাইতে বেশি পীড়ার কারণ হইয়াছে রাজ্য সরকারের জন্য,আর কাহারো জন্য নয়।কারণ এতো বৃহৎ বিপর্যয় গত ত্রিশ বৎসরের মধ্যে আসে নাই। রাজ্য প্রশাসনের জন্য ইহা একেবারেই নতুন ঘটনা।
গ্রাম ত্রিপুরার অর্থনীতি, কৃষকের জীবনে আজ নতুন সূর্যোদয় ঘটাইবার দায় ত্রিপুরার বর্তমান সরকারের উপর আসিয়া পড়িয়াছে। সকল কিছু নতুন করিয়া শুরু করাইতে হইবে।এই চ্যালেঞ্জ হইয়া যাইতেছে নিজের বিরুদ্ধে নিজের।জয় পাইতে হইলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশাসনকে সশক্ত করিতে হইবে, প্রশাসনকে এখনই তৈয়ার করিতে হইবে লড়াইয়ের জন্য।ভারত সরকার যেইহেতু ত্রিপুরা রাজ্যকে প্রাকৃতিক বিপর্যয়গ্রস্ত বলিয়া ঘোষণা দিয়াছে তখন পুনর্বাসনে অর্থের জোগান কোনও সমস্যা নহে।চ্যালেঞ্জ হইয়া দাঁড়াইবে শুধু প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তের কাছে পৌঁছানো এবং তাহাকে সঠিকভাবে সহায়তা দিয়া রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থার পুনর্নির্মাণ করা।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.