নজিরবিহীন সঙ্কট
ভারতকে ২০৪৭ সালের মধ্যে উন্নত দেশের সারিতে তুলে আনার লক্ষ্য স্থির করার কথা গত ১৫ আগষ্ট দেশের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে ঘোষণা করেছিলেন নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ভারত বাস্তব অর্থে কিন্তু খুব একটা ভালো নেই। কোনও দেশের মানুষের জীবনধারণের মান, তাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য কেমন চলছে-এর উপর প্রতি বছর মানব উন্নয়ন সূচক নির্ণয় করে থাকে । এই মানব উন্নয়ন সূচকের নিরিখেই একটি দেশের মানুষের সুখ – স্বাচ্ছন্দ্য , আর্থিক নিরাপত্তা এই বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে যায় । এ বছর রাষ্ট্রসংঘ তাদের ইউনাইটেড ন্যাশনস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম ( ইউএনডিপি ) -এর সর্বশেষ ২০২১-২২ সালের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ।
এই প্রতিবেদনে দেখা গেছে , বিশ্বের ১৮৯ টি দেশের মধ্যে ভারতের মানব উন্নয়ন র্যাঙ্কিং এই মুহূর্তে ১৩২ – এ এসে ঠেকেছে । অথচ ২০২০ সালে মানব উন্নয়ন সূচকে ভারতের স্থান ছিল ১৩১। রাষ্ট্রসংঘের এই প্রতিবেদনের পর বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশের এই পদস্খলন নি : সন্দেহে উদ্বেগের । সমাজ ও রাষ্ট্রে মানুষের অগ্রগতি তুলে ধরতে জনস্বাস্থ্য , শিক্ষা ও আয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন এবং এর র্যাঙ্ক নির্ধারণ করে থাকে রাষ্ট্রসংঘ । এই সূচক স্বাস্থ্য , শিক্ষা ও জীবনযাত্রার মানের নিরিখে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে তৈরি করা হয় । রাষ্ট্রসংঘের তৈরি করা এবারের প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৮৯ টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে অর্থাৎ ১ নম্বরে রয়েছে সুইজারল্যাণ্ড । এর পরে আছে নরওয়ে ও আইসল্যাণ্ড । অথচ এই তালিকায় চিনের স্থান ৭৯ , ভূটানের স্থান ১২৭ , বাংলাদেশের স্থান ১২৯ এবং ভারত ১৩২ এবং নেপালের স্থান ১৪০।
রাষ্ট্রসংঘের এই প্রতিবেদন নি:সন্দেহে ভারতের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে । রিপোর্ট বলছে , ভারতের মানুষের গড় আয়ু এখন অনেকটা কমে গেছে । ২০১৯ সালে ভারতের নাগরিকদের গড় আয়ু ছিল ৬৯.৭ বছর । এই মুহূর্তে ভারতে গড় আয়ু কমে দাঁড়িয়েছে ৬৭.২ বছর । শুধু একা ভারতই নয় , পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই তাদের নাগরিকদের আয়ু কমে গেছে । গোটা বিশ্বে ২০১৯ সালে মানুষের গড় আয়ু যেখানে ছিল ৭২.৮ বছর , এখন তা কমে এসে দাঁড়িয়েছে ৭১.৪ বছর ।কেন এমনটা হচ্ছে ? রাষ্ট্রসংঘের ইউএনডিপি তাদের প্রতিবেদনে বলছে , মানুষের আয়ু কমে যাওয়া , দেশের মানব উন্নয়ন সূচক নেমে যাওয়া এই ঘটনাগুলো একটি নির্দিষ্ট কারণে হচ্ছে এমন নয় । এর নেপথ্যে রয়েছে মানুষের নজিরবিহীন একগুচ্ছ সঙ্কট ।
রাষ্ট্রসংঘ এই বিষয়টিকে বলছে ‘ অনিশ্চিত সময় , অবিন্যস্ত জীবন ‘ । ইউএনডিপির প্রধান এসিম স্টেইনার রাষ্ট্রসংঘের এই প্রতিবেদন পেশ করে বলছেন , দেশের মানুষের উন্নয়ন সূচক নেমে যাওয়ার অর্থই হচ্ছে মানুষের আয়ুষ্কাল দিনদিন কমে যাচ্ছে । এর সঙ্গে আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যুক্ত । এর একটি হল মানুষের রোজগার কমছে এবং দ্বিতীয়টি হল আমরা কম শিক্ষিত হচ্ছি এবং স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় · চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি । এই পরিস্থিতি থেকেই মানুষের মনে জন্ম নেয় হতাশা ও উদ্বেগ । রাষ্ট্রসংঘের এই প্রতিবেদন যে উদ্বেগের কথা শুনিয়েছে তা হল , কোভিড অতিমারির পর থেকেই বিশ্বব্যাপী যে ক্ষতিকর প্রভাব শুরু হয়েছে , তার সরাসরি অভিঘাত এবার নেমে এসেছে মানুষের জীবনে ।
মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু কমছে , শিক্ষা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি হ্রাস পাচ্ছে । যদিও বিগত কয়েক দশকে বিশ্বব্যাপী মানব উন্নয়নে বেশকিছু সাফল্য অর্জিত হয়েছিল । কিন্তু বৈশ্বিকভাবে তা এখন নিম্নগামী । কোভিডের পাশাপাশি এই অবনমনের জন্য ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব ও জলবায়ু পরিবর্তনকেও -দায়ী করা হচ্ছে । তবে যেটা সবচেয়ে উদ্বেগের তা হল , ২০২২ সালের ভয়াবহ পরিস্থিতি আরও গুরুতর সঙ্কটের দিকে নিয়ে যেতে পারে মানুষকে । ফলে বিশ্বের ৮০ টির মতো দেশ ঋণ পরিশোধে অক্ষম হবে । যা আরও ভয়াবহ আকার নেবে ।