এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

অবিভক্ত ভারতবর্ষে মোঘল সাম্রাজ্যের শাসনামলে যিনি সবচেয়ে অ প্রভাবশালী শাসক হিসাবে ইতিহাসে পরিচিতি পেয়েছিলেন তিনি ছিলেন ঔরঙ্গজেব। প্রায় ৫০ বছর তিনি ভারত শাসন করে গেছেন।ইতিহাসের পাতায় বহু বছর আগে স্থান করে নেওয়া ঔরঙ্গজেবকে ঘিরেই ভারতীয় রাজনীতি ফের একটু একটু করে রং ধরতে চলেছে।মাত্র গত সপ্তাহেই মহারাষ্ট্রের নাগপুর শহরে মোঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের সমাধি সরানোর দাবিকে ঘিরে উত্তাল হয়ে উঠে পরিবেশ।আসলে ঔরঙ্গজেবের সমাধি নাগপুরে নয়।নাগপুর শহর থেকে ৪৫০ কিলোমিটার দূরে ঔরঙ্গজেব’কে সমাধিস্থ করা হয়েছিল।এতদিন যে স্থানটিতে ঔরঙ্গজেবকে সমাধি দেওয়া হয়েছিল তার নাম ছিল ঔরাঙ্গাবাদ। কিন্তু ২০২৩ সালে এই জায়গাটির নাম বদলে ছত্রপতি শিবাজীর বড় ছেলে সম্ভাজির নামে জেলার নাম রাখা হয় সম্ভাজি নগর।এর পাশেই খুলদাবাদ বলে একটা জায়গা আছে।এখানেই রয়েছে মোঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের সমাধি।কিন্তু ঘটনা হলো, ভিএইচপি সহ উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন সহ আরও বেশ কিছু মানুষ এই সমাধিটি সেখান থেকে সরানোর দাবি অনেক দিন আগে থেকেই করে আসছিল।আর সম্প্রতি এই ইস্যুতে এক বিক্ষোভ কর্মসূচিকে ঘিরেই উত্তপ্ত হয় নাগপুর।
আসলে ঔরঙ্গজেব হচ্ছেন ভারতীয় ইতিহাসের এক বিতর্কিত চরিত্র।আবার অনেকে বলেন তিনি আধুনিক ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে একজন নিষ্ঠুর ব্যক্তি।যে ব্যক্তি তার শক্তিশালী রাজপরিবারের উত্তরাধিকার বয়ে নিয়ে যেতে নিজের বাবাকে বন্দি করে বড় ভাইকে হত্যা করে সিংহাসনে বসেছিলেন, তিনি যে ক্ষমতাপিপাসু হবেন তাতে আশ্চর্য্যের কিছু নেই। যার বহিঃপ্রকাশ হিসাবে ১৬৫৮ থেকে ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তাঁর শাসনকালে হিন্দুদের প্রতি বৈষম্য ও অত্যাচারের যেমন অগণিত অভিযোগ উঠেছে।তেমনি হিন্দুদের প্রার্থনালয়ে হামলা এবং জোরজবরদস্তি মূলক সেগুলো দখল করারও অসংখ্য অভিযোগ ইতিহাসের পাতায় জ্বল জ্বল করছে ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে।নাগপরে ঔরঙ্গজেবের সমাধি স্থানান্তর নিয়ে তুমুল বিতর্ক আর অস্থির পরিবেশের মধ্যেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ তথা আরএসএস আজ এক তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা দিল।বেঙ্গালুরুতে আরএসএসের অখিল ভারতীয় প্রতিনিধি সভার বৈঠক শুরু হয়েছিল গত শনিবার থেকে।সোমবার ছিল সংঘের তিনদিনের বৈঠকের শেষ দিন। সেখানেই স্বয়ং সেবক সংঘের সহ কার্যবাহ দত্তাত্রেয় হোসবোলে বলেছেন ঔরঙ্গজেবের নীতি কোনওভাবেই ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খায় না। এখানে ধর্ম বা জাত কোনও বিষয় হল। বিষয় হলো ভারত প্রেম ও ভারতীয় সংস্কৃতি। তাই মোঘল সম্রাট ওরঙ্গজেব নন, ভারতের আইকন হতে পারেন তার বড় ভাই দারাশুকো।ভারতের জল-আবহাওয়ায় বরং দারাশুকোর গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি।
আর এস এসের সহকার্যবাহের এই বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে যে বিষয়টি ইঙ্গিতবাহী এবং তাৎপর্যপূর্ণ সেটি হল, সম্রাট শাহজাহান এবং তার স্ত্রী মুমতাজের বড় ছেলে ছিলেন দারাশুকো।ঔরঙ্গজেবের বিপরীত মেরুর মানুষ হিসাবেই ইতিহাস দারাশুকোকে চিত্রিত করেছে।শুধু তাই নয়, দারাশুকোর বরং মনে করা হয় প্রগতিশীল চিন্তক, দূরদর্শী কবি এবং সংবেদনশীল শাসক হিসাবে। ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে ভারতীয় সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতাও করেছিলেন তিনি। এমনকী ফার্সী ভাষায় গীতা ও উপনিষদের অনুবাদ করেছিলেন দারাশুকো। দারাশুকোকে নিয়ে রচিত উপন্যাস ও নাটক, মঞ্চে বাঙালির হৃদয়কে বিভিন্ন সময়ে ছুঁয়ে গেছে। ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে যুদ্ধে পরাস্ত হওয়ায় ঔরঙ্গজেবের নির্দেশেই তাঁর শিরচ্ছেদ করা হয়েছিল। ঔরঙ্গজেবের ঠিক বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়ে এরকম একজন ব্যক্তিত্ব দারাশুকোকে ভারতীয় সংস্কৃতির আইকন হিসাবে তুলে ধরার সংঘের এই চেষ্টা যথেষ্ট ইঙ্গিতপূর্ণ।
যেখানে ২০১৫ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর দিল্লীর ঔরঙ্গজেব রোডের নাম বদলে দিয়ে রাতারাতি এপিজে আব্দুল কালাম রোড নামাকরণ করা হয়েছে।সেখানে হোসাবোলে আরএসএসের প্রতিনিধি মঞ্চে কিসের বার্তা দিতে চাইলেন-তা নিয়েই চরম ফিসফিস কানাকানি আর গুঞ্জন নাগপুর থেকে দিল্লীর রাজপথ ধরে রাজনীতির সব অলি গলিতেই। হোসবোলে যখন এ দিন সাংবাদিকদের কে ঔরঙ্গজেবের সমাধি স্থানান্তর ইস্যুতে পাল্টা প্রশ্ন করে জানতে চান, যারা ঔরঙ্গজেব নিয়ে এত কথা বলছেন, কেন তারা দারাশুকোর মতো চরিত্রের কথা সামনে আনছেন না না। কেন দারাশুকোর মতো ব্যক্তিত্বকে তুলে ধরার পক্ষে সওয়াল করা হয়নি? আর এসএসের অন্যতম এই মুখ যখন ভারতীয় সংস্কৃতির পক্ষে সওয়ালের পাশাপাশি দারাশুকোর কথাও স্মরণ করতে ভুলেন না, তখন বুঝতে হবে ভারতীয় ইতিহাসের শ্রোত ধারা ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে কখনো থমকে গেলে বা আবার বাক্ নিলেও তা স্বকীয় ধারাতেই আবারো প্রাণ ফিরে পেতে পারে। এটা ঠিক ইতিহাস ও ইতিহাসবিদরা ঔরঙ্গজেবের কাজকর্মে তার প্রতি সদয় ছিলেন না। কিন্তু ৩০০ বছর আগে এক সম্রাটকে তার অনৈতিক কর্তৃত্ব ও রাজনীতির ভাবধারার আলোকে বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করে তা সংশোধনের জন্য রাজনীতির বা জাতপাতের বৃত্তে টেনে আনা নিশ্চয় প্রাজ্ঞতার পরিচয় বহন করে না। সেই নিরীখে হোসবোলের এই পর্যবেক্ষণ নিঃসন্দেহে নতুন পথের দিশা দেখাতে পারে।

Dainik Digital

Share
Published by
Dainik Digital

Recent Posts

নয়ডার ছাত্রী নিবাসে ভয়াবহ আগুন, প্রান রক্ষায় ঝাপ একের পর এক ছাত্রীর!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-নয়ডার ছাত্রী নিবাসে এসি বিস্ফোরণ থেকে ভয়াবহ আগুন লাগে। প্রাণ বাঁচাতে হোস্টেলের বারান্দা…

21 hours ago

উদ্ভাবনী প্রক্রিয়ায় কাজে লাগানো হচ্ছে ডম্বুরের জল-মুখ্যমন্ত্রী!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-ডম্বুর জলাশয়কে কেন্দ্র করে বিদ্যুৎ দপ্তরের যে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি রয়েছে তা থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে…

22 hours ago

বনরক্ষায় চারশ টিএসআর আধুনিক হাতিয়ার চাইলেন মন্ত্রী!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-রাজ্যের বনজসম্পদ রক্ষায় চারশ টিএসআর জওয়ান,আধুনিক হাতিয়ার, ইন্টিলিজেন্স ব্রাঞ্চ এবং স্পেশাল টাক্স ফোর্স…

22 hours ago

হাওড়ায় মহাপ্লাবন রুখতে গুচ্ছ পরিকল্পনা,বন্যারোধে ড্রাফট কনসেপ্ট তৈরি: মুখ্যমন্ত্রী!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-অল্প বৃষ্টিতে মহাপ্লাবন রুখতে হাওড়া নদীকে কেন্দ্র করে গুচ্ছ পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে।…

22 hours ago

পর্যটন কেন্দ্রগুলি ঢেলে সাজানো হচ্ছে, ১৪৭.১৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে ১২টি মোটরস্ট্যান্ড: সুশান্ত!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-রাজ্যের পরিবহণ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে বিশেষ উদ্যোগ ও পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে পরিবহণ…

23 hours ago

জোড়া ভূমিকম্প মায়ানমারে,ক্ষয়ক্ষতি প্রচুর, সুইমিংপুলে জলোচ্ছ্বাস!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-জোড়া ভূমিকম্প মায়ানমারে। জোড়া ভূমিকম্পে কেপে উঠল বাংলাও। জানা গিয়েছে, শুক্রবার সকালে মায়ানমারে…

23 hours ago