নবরূপে ন্যায়দেবী

এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

ঔপনিবেশিক মোহগ্রস্ততার মায়াজাল থেকে আরও এক কদম বেরিয়ে এলো আমাদের দেশ। কোজাগরী পূর্ণিমার শুভক্ষণে পাল্টে গেলো ভারতীয় বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতার প্রতীক ‘ন্যায়ের মূর্তি’। নবকলেবরে সামনে এলেন ন্যায়ের দেবী। এখন ন্যায়দেবীর চোখে আর বাঁধা নেই কাপড়ের পট্টি। তার দুই চক্ষু উন্মীলিত, মস্তকে কিরীট। নারীমূর্তির দক্ষিণ হস্তে তুলাদণ্ডটি অটুট থাকলেও তার বাম হাতে তরবারির বদলে ধরা রয়েছে ভারতের সংবিধান গ্রন্থ। দেশের প্রধান বিচারপতি ধনঞ্জয় যশবন্ত চন্দ্রচূড়ের নির্দেশে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের গ্রন্থাগারে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন স্থাপিত হয়েছে। ন্যায়দেবীর শ্বেতশুভ্র এই নতুন মূর্তি।
ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতীয় বিচারব্যবস্থায় ন্যায়ের প্রতীক ছিল এক হাতে তুলাদণ্ড, অন্য হাতে তরবারি, চোখে পট্টি বাঁধা ন্যায়দেবীর প্রস্তর মূর্তি। ন্যায়ের দেবীর চিরপরিচিত প্রাচীন মূর্তিটির উৎস সন্ধান করলে দেখা যাবে, রোম থেকে মিশরীয় সভ্যতার প্রাচীন ইতিহাস। দীর্ঘ বছর পরে সেই যোগ ছিন্ন করে নতুন ন্যায়ের মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হলো। এতকাল ন্যায়দেবীর হাতে তরবারি ছিল সাজা দেওয়ার প্রতীক। প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় মনে করছেন, আইনের চোখে সবাই সমান ঠিকই, কিন্তু আইন কখনও অন্ধ থাকতে পারে না। আর আইন মানে শুধুই শাস্তি নয়, যেখানে তরবারি মূলত হিংসার প্রতীক। বাস্তবিক, যথার্থ ও পরিবর্তন, আইনের রায় হিংসার উপর ভিত্তি করে হয় ত্বরান্বিত হয় না, বরং হয় সংবিধানের আলোকে। আদালত রায় দেয় সংবিধানিক আইন মেনে। তাই প্রধান বিচারপতির ভাবনার সূত্র ধরে ন্যায়ের দেবীর মূর্তির বাঁ হাতে তরবারির বদলে এসেছে সংবিধান। তুলাদণ্ডটি আগের মতোই রয়েছে, যার প্রতীকী অর্থ আদালত দুই তরফের বক্তব্যের তুল্যমূল্য বিচার করেই রায় দেয়। একার্থে এই তুলাদণ্ড সামাজিক ভারসাম্যেরও প্রতীক। ধন্যবাদার্হ প্রধান বিচারপতি, কারণ তিনি উপলব্ধি করেছেন যে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক মায়াজাল ছিন্ন করে এখন দেশের এগিয়ে চলার সময়। সম্ভবত সেই ভাবনায় প্রতিমূর্তিতে বদল আনতে চেয়েছেন তিনি। তর্কের খাতিরে প্রশ্ন জাগতেই পারে যে, ‘ন্যায়ের বন্ধ চোখ খুলে যাওয়া’, কতদূর সঙ্গত? চোখবাঁধা পুরনো মূর্তিটি প্রতীকী অর্থে বোঝাত, আইনের চোখে সকলেই সমান। কারও শক্তি বা সম্পদ দেখে না আদালত, এটি তাদের বিচার্যই নয়।
আইনজ্ঞদের বৃহদংশ নবরূপে ন্যায়মূর্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন। তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে ১৬৪ বছরের পুরনো ভারতীয় দণ্ডবিধির বদলে ন্যায় সংহিতা চালু করেছে মোদি সরকার। এবার সংবিধান হাতে ন্যায়ের দেবী চোখ মেললেন। যার অর্থ, আইনের চোখে সবাই যেমন সমান ঠিকই, তবে বিচার অন্ধভাবে করা হয় না। আইন অন্ধ নয়- আদালত সকলকে সজাগভাবে নিরীক্ষণ করে তবেই বিচার করে এবং সেমতে রায়দান করে। কোনও সন্দেহ নেই, ন্যায়দেবীর এই রূপবদল বিচারব্যবস্থায় শক্তি বা রা হিংসার পরিবর্তে সংবিধান এবং সুষম ন্যায়ের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে,
যা আধুনিক ভারতের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতিফলন। গণতন্ত্রের আব্রুরক্ষায় ভারতের সাধারণ মানুষের শেষ ভরসা যে সুপ্রিম কোর্ট, তাতে সংশয়ের কোনও অবকাশ নেই। কিন্তু নিলজ্জ সত্য এই যে, সংবিধানের ভিত্তিগত দর্শনকে অস্বীকার করে নাগরিকের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলেও রাজনৈতিক দলগুলি স্বেচ্ছায় নিবৃত্ত থাকে না। সেই কারণেই নাগরিক সুপ্রিম কোর্টের উপর আরও বেশি নির্ভরশীল। শিশুর যেমন মাতৃক্রোড়, সাধারণ মানুষের ভরসার শেষ স্থল তেমনই আদালত। ভারতের রাজনীতি, ব্যবসাজগতে দুর্নীতি নিয়ে বহু আলোচনা হয়। কিন্তু দ্রুত বিচার সুনিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই যে বহুলাংশে দুর্নীতি রুখে দিতে পারা যায়, সেই জরুরি কথাটি সামনে আসে না। কোনও নেতা বা তারকার বিচার পাওয়া, না পাওয়াকে কেন্দ্র করে সমাজ মাঝে মধ্যে আলোড়িত হয় বটে, কিন্তু বৃহত্তর জনসাধারণের বিচার পাওয়া, না পাওয়াতে আমরা বড়ই নির্বিকার। বিচারের শ্লথগতি যে আমাদের গণতন্ত্রকে রাজনীতিকদের হাতের ক্রীড়নক করে তুলছে, আমরা তার কতটুকু উপলব্ধির চেষ্টা করি! সংবিধানেই আইনবিভাগ ও শাসনবিভাগকে বিরাট ক্ষমতা দেওয়া আছে, আবার পাশাপাশি তার আ
সঙ্গে সেই ক্ষমতার একটি সীমাও নির্ধারিত করে দেওয়া আছে। শাসনবিভাগীয় কার্যধারার গতিরেখাটি শীর্ষ আদালতের মতামত নিরপেক্ষ যাতে না হয়, তা নিশ্চিত করার চেষ্টা আছে। একেই বলা হয় গণতন্ত্রের তিনটি স্তম্ভের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা। এই ভারসাম্য নষ্ট হলে, এত বড় দেশে- শাসনবিভাগীয় ক্ষমতা একদিকে বিপুলভাবে হেলে পড়লে, গণতন্ত্রে মূল ভিত্তিটিই ভেঙে পড়তে পারে। তাই শুধু ন্যায়মূর্তির রূপবদলই যথে নয়, প্রয়োজন আইনকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার ক প্রতিপক্ষকে নাজেহাল করার বিপজ্জনক প্রবণতার মূলোৎপাটন করা।

Dainik Digital

Share
Published by
Dainik Digital

Recent Posts

রক্তচাপ বেড়ে শারিরীক অবস্থার অবনতি সিমলার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সোনিয়া!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-শনিবার আচমকাই অসুস্থ হয়ে পড়লেন কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী। তড়িঘড়ি তাঁকে ইন্দিরা গান্ধী…

12 mins ago

৪০০ ড্রোন ও ৪০ মিসাইল ছুড়ল রাশিয়া ইউক্রেনকে!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-শুক্রবার রাতভর ইউক্রেনের একাধিক শহরে ৪০০-র বেশি ড্রোন এবং অন্তত ৪০ মিসাইলের মাধ্যমে…

15 hours ago

চলতি মাসেই ফের বঙ্গ ভিজিটে নরেন্দ্র মোদি, জনসভার সম্ভাবনা দক্ষিণবঙ্গে!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-ফের একবার জুন মাসে রাজ্য সফরে আসতে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি । সূত্রের…

15 hours ago

বিরাট কোহলির বিরুদ্ধে থানায় এফআইআর!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-কর্নাটকের শিবমোগা জেলার সমাজকর্মী এএম বেঙ্কটেশ ভারতীয় ক্রিকেট অধিনায়ক বিরাট কোহলির বিরুদ্ধে অভিযোগ…

17 hours ago

জাতীয় সড়কে জরুরি অবতরণ হেলিকপ্টারের বরাত জোরে বাঁচলেন ছয় পুণ্যার্থী!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-কেদারনাথ যাওয়ার পথে ঘটল বিপত্তি। ছয়জন পুণ্যার্থী নিয়ে কেদারনাথ যাওয়ার পথে রাজপথেই জরুরি…

18 hours ago

ঈদের দিনে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর অতর্কিত হামলায় মৃত্যু ৪২ ফিলিস্তিনির!

অনলাইন প্রতিনিধি :-পবিত্র ঈদুল আজহার দিনেও থেমে থাকল না গাজার মৃত্যমিছিল। স্থানীয় চিকিৎসা সূত্রের দাবী,…

22 hours ago