নারাজ বিরোধী
প্রতিবছর নির্বাচন কমিশনের প্রতিষ্ঠা দিবস ২৫ জানুয়ারী দিনটিকে জাতীয় ভোটার দিবস হিসাবে পালন করা হয়। গত বছর জাতীয় ভোটার দিবস অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশন দেশে রিমোট ইলেকট্রনিক ভোটিং কর্মসূচি চালু করার পরিকল্পনার কথা ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেই সময় দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ছিলেন সুনীল অরোরা। তিনি একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেছিলেন, দেশে এখনও এমন ত্রিশ কোটি ভোটার রয়েছেন, যাদের নাম ভোটার তালিকায় লিপিবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও তারা তাদের পবিত্র গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করেন না।
কেন এই ৩০ কোটি ভোটার ভোট দিচ্ছেন না, এর কারণ ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে নির্বাচন কমিশনার জানান, এমন প্রচুর সংখ্যক শ্রমিক রয়েছেন যারা এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে গিয়ে কাজ করেন। এই পরিযায়ী শ্রমিকেরা ছাড়াও রোজগারের প্রয়োজনে, কর্মসূত্রে বা চাকরির কারণে, বিয়ে হয়ে অন্য রাজ্যে স্থানান্তর হওয়ার কারণে কিংবা উচ্চশিক্ষা বা পড়াশোনার কারণে অনেক ভোটারই নিজের বাসস্থান ছেড়ে অন্যত্র বসবাস করছেন। তারা হয়তো নানা কারণে নতুন ঠিকানায় ভোটার তালিকায় নাম তোলেন না। নির্বাচন কমিশনের হিসাব মতো যে ৩০ কোটি ভোটার ভোট দেন না, এদের মধ্যে ৮৫ শতাংশই হচ্ছেন এ ধরনের ভোটার।
কমিশন বলছেন, এই জাতীয় পরিযায়ী শ্রমিক, পড়ুয়া, কাজের সূত্রে ভিন্ রাজ্যে থাকা, যারা অনেকেই দূরত্বের কারণে ভোটের সময় নিজের জায়গায় ভোট দিতে যেতে পারেন না তাদের ভোট দেওয়ার সুযোগ করে দিতে কমিশন একটি কর্মপরিকল্পনা নিয়েছে। আগামী ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন থেকে এই প্রক্রিয়া চালু করার ভাবনা রয়েছে। এই নতুন পদ্ধতিটি হলো রিমোট ভোটিং বা ই-পোস্টাল ব্যালট। নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী ভোট দেওয়ার জন্য এ ধরনের ভোটারদের আর নিজের এলাকার বুথে গিয়ে ভোট দেওয়ার প্রয়োজন নেই। বরং দেশের যেকোনও প্রান্তে বসেই তারা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন।
কিভাবে এই ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে তা হাতে কলমে সব স্বীকৃত রাজনৈতিক দলকে ডেকে প্রদর্শন করার জন্য আজই বৈঠক ডেকেছিল নির্বাচন কমিশন। কিন্তু কমিশনের এই ভাবনাচিন্তা ও পরিকল্পনা নিয়ে প্রায় সব কয়টি বিরোধী রাজনৈতিক নিয়ে দল সংশয় সন্দেহ ও প্রশ্ন তুলেছে। ২০২৪-এর লোকসভার ভোটে এই ফরমুলা কাজে লাগানো মানেই বিরোধী দলগুলোর মতে এ হলো বিজেপিকে লোকসভার ভোটে জেতানোর ছক। আর সেকারণেই পরিযায়ী শ্রমিক,পড়ুয়া ও রোজগারের আশায় বহিঃরাজ্যে কর্মরতদের চিহ্নিত করে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার আর ওড়িশার ভোটে বিজেপিকে সুবিধা দিতে চাইছে কমিশন— এমনটাই বক্তব্য বিরোধী দলগুলোর।
দেশের সব ভোটার যাতে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন সেটা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনের এই পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে প্রশংসায় দাবি রাখে। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, কমিশন ভোটের জন্য যে পদক্ষেপই গ্রহণ করুন না কেন, সেটা যেন সরল, ত্রুটিমুক্ত, সংশয়হীন এবং সর্বজনগ্রাহ্য হয়- সেটা সর্বাগ্রে নিশ্চিত করা জরুরি। কারণ এক রাজ্যের ভোটার যখন অন্য রাজ্যে বাস করেন এবং নিজের রাজ্যের ভোটের সময় যখন তিনি সেখান থেকে ভোট দেবেন তখন ওই রাজ্যে হয়তো ভোট নাও থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে ভোট দেবেন তার উপর আচরণবিধি, নজরদারি, এজেন্ট নিয়োগ সবকিছু কীভাবে বলবৎ করা সম্ভব সেটা যথেষ্ট জটিল।
সবচেয়ে বড় কথা হলো এর সঙ্গে জনপ্রতিনিধি আইন, নির্বাচন পরিচালন বিধি, ভোটের নথিভুক্তি বিধির মতো বিষয় যুক্ত রয়েছে। তাই সার্বিকভাবে দরকার নির্বাচনি সংস্কার। নির্বাচনি সংস্কারের জেরেই এদেশে সচিত্র পরিচয়পত্র চালু, ইভিএমের সঙ্গে ভিভিপ্যাট যুক্ত করার মতো বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আজকের স্বীকৃত রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠকের পর আগামী ৩১ জানুয়ারীর মধ্যে তাদের মতামত ও অবস্থান ব্যক্ত করবেন। প্রয়োজনে তারা কমিশনকে কিছু প্রস্তাব ও সংশোধনীর কথাও বলতে পারেন। তবে সার্বিক বিচার বিশ্লেষণ ও সহমতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত রূপায়ণ এবং তা স্বচ্ছভাবে সন্দেহের বাতাবরণের উর্ধ্বে উঠে কার্যকর করা সম্ভব হলেই গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে এবং জনপ্রতিনিধিত্ব বাস্তব অর্থেই ফলপ্রসূ হবে।