নৃশংসতার জ্বলন্ত দলিল!!

 নৃশংসতার জ্বলন্ত দলিল!!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে ভারত পরিচিত।পাকিস্তান পেরিয়ে কাশ্মীরে ঢুকে জঙ্গিদের হামলা চালানোর ঘটনাও নতুন নয়।কিন্তু স্মরণকালের মধ্যে নিরস্ত্র নাগরিকদের উপর জঙ্গিদের এমন বর্বরোচিত নাশকতা, স্ত্রী-সন্তানদের সামনে রেখে নির্বিচারে পর্যটকদের এমন হত্যাযজ্ঞ, স্মরণকালের মধ্যে কাশ্মীরে হয়নি। প্রত্যাশিতভাবেই কেন্দ্রীয় সরকার পদক্ষেপ করেছে।সৌদি আরবের সফর ছেঁটে বুধবার ভোরেই দেশে ফিরে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। মঙ্গলবার রাতেই শ্রীনগরে পৌঁছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী সহ সব পক্ষকে নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের পর বুধবার সকালে পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলায় নিহতদের শেষ শ্রদ্ধা জানান। কথা বলেন, নিহতদের পরিজনদের সঙ্গে। জরুরি পরিস্থিতিতে কাশ্মীরে পৌঁছেছে জাতীয় তদন্তকারী দল এনআইএ।আন্তর্জাতিক শক্তিও ভারতের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
প্রকৃত অর্থে পহেলগাঁওয়ে জঙ্গিদের এই গণহত্যা যোগ করেছে সম্পূর্ণ নতুন একটি অধ্যায়।মরিয়া জঙ্গিরা বুঝিয়ে দিয়েছে, এতদিন তারা ভূস্বর্গের পর্যটকদের রেহাই দিয়েছে বটে, তবে এবার সেটাও আর দেবে না। জঙ্গিরা যেন অসহায়তা আর নৃশংসতার জ্বলন্ত দলিল দেখাতে চেয়েছে। ২০১৯ সালে পুলওয়ামার পরে কাশ্মীরে একাধিক হামলা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু পর্যটকদের জঙ্গিরা নিশানা বানালো উনিশ বছর পর। ২০০৬ সালের ২৬ মে শ্রীনগরের উপকণ্ঠে সন্ত্রাসবাদীরা একটি পর্যটক বোঝাই বাসে গ্রেনেড হামলা চালালে চারজন পর্যটক নিহত এবং ছ’জন আহত হয়েছিলেন। নিহতরা সকলেই ছিলেন গুজরাটের বাসিন্দা। ঘটনাচক্রে, সে সময় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র মোদি। ২০১৭ সালে অনন্তনাগে অমরনাথের যাত্রার উপর জঙ্গি হামলা হলে মৃত্যু হয়েছিল আটজন পুণ্যার্থীর। কাশ্মীরে নিরস্ত্র নাগরিকদের উপর জঙ্গিরা এমনই বর্বরতা দেখিয়েছিল ২০০১ সালে। ঘটনাচক্রে, কেন্দ্রে তখন বাজপেয়ী সরকার।শ্রীনগরের রাজ্য বিধানসভার উপর আত্মঘাতী সেই হামলায় তিন জঙ্গি সহ ছত্রিশজন মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
২০১৯-এর আগষ্টে সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল হওয়ার পর থেকে উপত্যকায় জঙ্গিদের ইতস্তত হামলা বেড়েছে। জঙ্গিদের বুলেটে ভিন রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকরা মাঝেমধ্যেই খুন হয়েছেন। অমরনাথ, বৈষ্ণোদেবী বা অন্যান্য ধর্মস্থানে আগত পুণ্যার্থীরাও বারবার জঙ্গি হামলার শিকার হয়েছেন। কিন্তু পহেলগাঁওয়ে ‘মিনি সুইৎজারল্যান্ড’ বলে পরিচিত নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ঘেরা বৈসরণ উপত্যকায় স্ত্রী-সন্তানদের সামনে রেখে যে নশংসতায় পর্যটকদের খতম করা হয়েছে,বীভৎসতায় অতীতের সব জঙ্গি হানাকে তা ছাপিয়ে গেছে। এখন রাজনীতির তো নয়-ই, ছিদ্রান্বেষণেরও সময় নয়। এই ঘটনা নিন্দার অতীত। আরএসএসের তরফে বলা হয়েছে, এটা দেশের সংহতির উপরে হামলা। সব রাজনৈতিক দলের উচিত মতভেদ ভুলে এর নিন্দা করা।
একেবারে যথার্থ।তবু কিছু অপ্রিয় প্রশ্ন উঠবেই, উঠেওছে।কারণ,এত বড় নাশকতার ঘটনার রেশ আরও কত বছর কাশ্মীরকে বইতে হবে জানা নেই। পর্যটনই সেখানে মূল জীবন-জীবিকা। পর্যটকশূন্য হয়ে গেলে ভূস্বর্গের লোকজন কী খাবে? জঙ্গিরা কাদের নাম বা হিন্দু ধর্মপরিচয় জেনে একে একে খুন করলো? খুন তো, প্রকৃত প্রস্তাবে, তারা করল কাশ্মীরের আম জনতাকে! রুজি-রোজগার শূন্য করে দিলো। এ দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার বিরুদ্ধে জঙ্গিদের যদি এত আক্রোশ, তবে তার বদলা নিরীহ সাধারণ মানুষের উপরে কেন? জঙ্গিরা কি জানত না যে, এই ঘটনায় দিনের শেষে কাদের রাজনৈতিক লক্ষ্মীলাভ হবে?এই ঘটনার পরে কারা আরও বেশি বেশি করে ‘এক হ্যায় তো সেফ হ্যায়’ স্লোগান দেওয়ার সুযোগ পেয়ে যাবে!কাশ্মীরে বিশেষ মর্যাদা রদের পর থেকে উপত্যকায় ছোটখাটো জঙ্গি হামলার ঘটনাগুলিকে কেন যথোচিত গুরুত্ব দেয়নি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক? তা দিলে পর্যটকদের ভরা এই মরশুমে পুলিশ ও সেনা সতর্ক থাকলে, এত বড় ঘটনা ঘটত কি?পুলওয়ামা কাণ্ডের মতো এবারেও গোয়েন্দারা কেন আগাম কোনও খবর পাননি?জঙ্গিরা রিসর্ট জিহাদের পরিকল্পনা করছে, পর্যটকপ্রেমী বিভিন্ন জায়গা রেইকি করছে, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের কাছে কোনও খবরই ছিল না, এটা বাস্তবিকই আশ্চর্যের!
পহেলগাঁওয়ে ধর্মীয় পরিচয় জেনে পর্যটকদের খুন যদি জঙ্গিদের পরিকল্পিত ‘হিন্দু নিধন যজ্ঞ’ হয়ে থাকে এবং রক্তবন্যার ওই উদভ্রান্ত মুহূর্তে যদি তারা সে কথা বলে থাকে, তার অর্থ আদতে মেরুকরণের ক্ষেত্রে জঙ্গিরাই জল-সার দিয়েছে। ধর্মীয় বিভাজনের পথ সুপ্রশস্ত করেছে। পাকিস্তানের পুরোনো সেই কৌশল, ‘টু ব্লিড ইন্ডিয়া বাই এ হাউজ্যান্ড কাটস’ অর্থাৎ হাজার টুকরো করে ভারতকে রক্তাক্ত করো…. সেই ‘অপটিক্স’ পহেলগাঁওয়ে জঙ্গিরাই নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছে। অত:কিম? পহেলগাঁওয়ের বদলা আরও একটা সার্জিক্যাল স্ট্রাইক? যার প্রত্যক্ষ প্রভাবে মেরুকরণে ঝড় উঠবে চলতি বছরের শেষ লগ্নে অনুষ্ঠেয় বিহার বিধানসভা নির্বাচনে?দেশের সামরিক
ক্ষমতা নিয়ে আমাদের তিলার্ধ সংশয় নেই।তবে দেখার বিষয়,রাজনৈতিকস্তরে
পহেলগাঁও কাণ্ডের শাখা-প্রশাখা শেষ পর্যন্ত কতদূর বিস্তার লাভ করে।রক্তের বদলে আরও রক্ত।এর শেষ কোথায়!

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.