ন্যায় বনাম গ্যারান্টি!!
ভারতীয় গণতন্ত্রে নির্বাচনের সাথে প্রতিশ্রুতির সম্পর্কটা একেবারে জল ও মাছের মতো। একশ চল্লিশ কোটির দেশে যে কোনও নির্বাচনেই প্রতিশ্রুতির বন্য বয়ে যায়। সে পঞ্চায়েত স্তরের নির্বাচনই হোক, কিংবা বিধানসভা, লোকসভা নির্বাচন। প্রতিশ্রুতি ছাড়া নির্বাচন- ভাবাই যায় না! এই দেশে একেবারে ক্লাশ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সমিতি, কর্পোরেশন, স্বশাসিত সংস্থা, অর্থাৎ যেখানেই নির্বাচন সেখানেই থাকে প্রতিশ্রুতি। রাজনৈতিক দলগুলি থেকে শুরু করে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সকলেই প্রতিশ্রুতি দেয়। নির্বাচনে জয়ী হলে আমরা অমুকটা করবো, তমুকটা করবো! সেই প্রতিশ্রুতিতে নানা ধরনের চমক থাকে। নানা ধরনের লোভনীয় প্রস্তাব থাকে। নানা ধরনের মাধুর্য থাকে। উদ্দেশ্য একটাই, যেভাবেই হোক ভোটারদের আকৃষ্ট করা। ভোটারদের প্রলোভন দিয়ে প্রভাবিত করা। যাতে প্রভাবিত হয়ে ভোটাররা ভোট দিয়ে নির্বাচনে জয়ী করে। নির্বাচনের এই প্রতিশ্রুতিকে সহজভাবে ‘টোপ’ও বলা যেতে পারে। যেমন টোপ দিয়ে বড়শির কাঁটা দিয়ে জল থেকে মাছ শিকার করা হয়-অনেকটা তেমনই। নির্বাচনে মাছের বদলে ‘ভোটার’ ধরতে হয়। ফারাক শুধু এইটুকুই। যে দল যত বেশি ভোটার ধরতে পারবে, যে দল যত বেশি ভোটারদের প্রভাবিত করে নিজেদের পক্ষে আনতে সফল হবে, নির্বাচনের ফলাফল সেই দল বা প্রার্থীর অনুকুলে যাবে এতে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে
স্বাধীন ভারতের গণতন্ত্র এই পথেই প্রবাহিত হচ্ছে। ভোট এলেই প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি। ভোট ফুরোলেই সেই প্রতিশ্রুতি কতটা পূরণ হয়, তা নিয়ে বহু বিতর্ক রয়েছে। গত পঁচাত্তর বছরে এই দেশে যত প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে জনগণকে তার অর্ধেকও যদি বাস্তবায়ন হতো, তাহলেও ভারত আজ বিশ্বের উন্নয়নের মানচিত্রে বিশেষ জায়গায় থাকতো। তা হলফ করে বলা যায়। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, তারপরও জনগণ প্রভাবিত হয়। প্রতিশ্রুতি পূরণ নাও হতে পারে, এটা জেনেও আশায় বুক বাঁধে। মনে প্রাণে বিশ্বাস করে ঠকে যাওয়া, প্রতারিত হওয়ার বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। তারপরেও ভোট
এলে পূর্বের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ না করা সত্ত্বেও, নতুন করে প্রতিশ্রুতি দেয় জনগণকে। জনগণও সেই প্রতিশ্রুতিতে আকৃষ্ট হয়। দেশে ফের লোকসভা নির্বাচনের দামামা বেজে গেছে। ইতিমধ্যে শাসক-বিরোধী সব রাজনৈতিক দলই ঢালাও প্রতিশ্রুতি নিয়ে ভোটের ময়দানে হাজির হয়েছে। তবে সময়ের সাথে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার ধরন এবং নামেও এখন পরিবর্তনের ছোঁয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আগে যা বলা হতো ‘ইস্তাহার’, এখন সেটা ‘সংকল্প পথ’। ইংরেজিতে ‘ভিশন ডকুমেন্ট’। এখন আরও একধাপ এগিয়ে ভোটের প্রতিশ্রুতির নয়া সংস্করণ সামনে এসেছে। এবার লোকসভা নির্বাচনে প্রতিশ্রুতির নয়া সংস্করণ হচ্ছে ন্যায় এবং গ্যারান্টি। শাসক দল বিজেপির প্রতিশ্রুতির নতুন সংস্করণের নাম হচ্ছে ‘মোদি কি গ্যারান্টি’।
অন্যদিকে কংগ্রেসের ‘ন্যায় গারান্টি’। রাজনৈতিক মহলের মতে, এখন আর ইস্তাহারে ভরসা রাখতে পারছে না রাজনৈতিক দলগুলি। এখন আর শুধু প্রতিশ্রুতি দিলেই হবে না বুঝতে পেরে প্রতিশ্রুতির গ্যারান্টি দিতে হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন, তাহলে কি রাজনৈতিক দলগুলি বুঝতে পারছে যে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস, আস্থা তলানিতে এসে ঠেকেছে? শুধু প্রতিশ্রুতি এবং মুখের কথায় ভোটাররা ভোট দেবে না? শুধু গালভরা ভাষণ দিয়ে নিজেদের অনুকূলে ভোট টানা যাবে না? এই জন্যই কি শাসক দল বিজেপি মোদির নামে উন্নয়নের গ্যারান্টি দিচ্ছে? অপর দিকে কংগ্রেস দেশবাসীকে ন্যায় দেওয়ার গ্যারান্টি দিয়ে আস্থা অর্জনের প্রয়াস নিয়েছে? জবাব মিলবে আগামী ৪ জুন। ন্যায় বনাম গ্যারান্টির মধ্যে শেষ পর্যন্ত কে জয়ী হবে? দেশবাসী কাকে বেছে নিলো, জানা যাবে ভোট গণনার পর। ততদিন অপেক্ষাতো করতেই হবে।