পক্ষপাতদুষ্ট!!
দশ বছর ধরে বিরোধীদের অভিযোগ ছিল,প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দকে কেন একবারও সাংবাদিক সম্মেলন করেননি।অপ্রিয় প্রশ্ন এড়িয়ে যেতেই তিনি নাকি সংবাদমাধ্যমকে এড়িয়ে চলেন, আর যেখানে কারও প্রশ্ন নেওয়ার দায় নেই, স্মার্ট ফোনের প্রসারকে কাজে লাগিয়ে সেই সমাজমাধ্যমে, রেডিওতে তিনি কেবল নিজের কথা বলে দেশবাসীর সঙ্গে সংযোগ তৈরি করেন। দশ বছর পরে, ভোটের ভরা মরশুমে প্রধানমন্ত্রী নিজেই পরোক্ষে বিরোধীদের সে অভিযোগের জবাব দিয়েছেন।জানিয়েছেন,কেন তিনি এতদিন কোনও সাংবাদিক সম্মেলন করেননি। সংবাদমাধ্যমকে এড়িয়ে যাওয়া নয়, প্রধানমন্ত্রী যে কারণ উল্লেখ করেছেন তার নির্যাস,এখনকার সংবাদমাধ্যম পক্ষপাতদুষ্ট। সম্প্রতি এক সংবাদমাধ্যমকে একান্ত সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি শুধু সংসদের কাছে দায়বদ্ধ। অর্থাৎ তিনি অন্য কারও কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন।যেখানে দায়বদ্ধতা নেই, সেখানে বাধ্যবাধকতাও নেই। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সংবাদমাধ্যমের চরিত্র আগের মতো নিরপেক্ষ আর নেই, আমূল বদলে গেছে। সাংবাদিকেরা নিরপেক্ষ নন। তারা প্রত্যেকে নিজস্ব অভিমতের মধ্যে আবদ্ধ। মোটের উপর এখন তা হয়ে উঠেছে উদ্দেশ্যমূলক সাংবাদিকতা।প্রধানমন্ত্রীর কথায়, আগে মিডিয়া ছিল মুখহীন।কে লিখছেন, কী লিখছেন,তার আদর্শ কী,তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা ছিল না।কিন্তু আজ এটা স্পষ্টভাবেই বোধগম্য যে,কার কী আদর্শ,কার কী রাজনীতি। প্রধানমন্ত্রী দাবি করেছেন, তিনি এক নয়া সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছেন।সেটি কী? প্রধানমন্ত্রীর কথায়, আগে এমন একটি ধারণা ছিল কিছু করার প্রয়োজন নেই,শুধু মিডিয়াকে হাতে রাখো। নিজের কথাটা তাদের জানিয়ে দাও। তারাই দেশজুড়ে তা প্রচার করে দেবে। কিন্তু, তিনি ওই রাস্তায় হাঁটেননি। তিনি এক অন্য সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছেন। খাটতে হবে। পরিশ্রম করতে হবে। গরিবদের ঘরে ঘরে যেতে হবে। এই সংস্কৃতি মিডিয়ার পছন্দ হলে তারা তা প্রচার করবে।পছন্দ না হলে প্রচার করবে না।আগে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল সংবাদপত্র। আজ বহু মাধ্যমের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। জনতাও আজ নিজের স্বর বৃহত্তর সমাজে পৌঁছে দিচ্ছে। যেকোনও বিষয়ে মানুষ তার মতামত জ্ঞাপন করতে পারছে।অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী বোঝাতে চেয়েছেন, তিনি সরাসরি জনসংযোগ করেন, তাই সাংবাদিক সম্মেলন এখন প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে।
বাস্তবিক, সংস্কৃতি বদলে দিয়েছেন মোদি।অতীতে প্রধানমন্ত্রীর বিদেশযাত্রার সঙ্গী হতো দেশের নানা কাগজ-চ্যানেলের সাংবাদিকদের একটি দল। কিন্তু মোদির সঙ্গী শুধু দূরদর্শন।তাকে সরাসরি প্রশ্ন করার সব রাস্তা বন্ধ।তবে প্রধানমন্ত্রী ওই সাক্ষাৎকারে যা বলেননি তা হলো, গোটা সংবাদমাধ্যমকেই অপ্রাসঙ্গিক, নিষ্প্রয়োজন করে তোলার উদ্যোগ করা হয়েছে এই জমানায়।তবে সারসত্যটি তিনি বলে ফেলেছেন, সেটি হলো এখানকার সংবাদমাধ্যম পক্ষপাতদুষ্ট।আগে যে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম তুলনায় নিরপেক্ষ ছিল, এখন বদলে গেছে, আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স’ কর্তৃক ২০২৩ সালের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সংক্রান্ত সূচক সেকথারই পরিচায়ক।এই সূচকে ২০০২ সালে ভারতকে তারা রেখেছিল আশি নম্বরে।২০১৪ সালে, মোদি জমানার সূচনায় ভারত ছিল ১৪০।২০২৪ সালে ভারতের স্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬১।ওই রিপোর্টে যে ৩১টি দেশকে সাংবাদিকদের জন্য ‘খুবই বিপজ্জনক’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, তার অন্যতম ভারত।এছাড়া ওই সূচকে সাংবাদিকদের নিরাপত্তার মাপকাঠিতে ভারতের স্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৭২তম।চিন, মেক্সিকো, পাকিস্তান, সিরিয়া, ইরান, ইয়েমন, ইউক্রেন, মায়ানমার শুধু রয়েছে ভারতের পেছনে। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, ভারতের আইনে নাগরিকের নিরাপত্তার সংস্থান থাকলেও ইদানীং সরকারের সমালোচনা করলেই তাদের দেশবিরোধী বলে দাগিয়ে দেওয়া, রাষ্ট্রদ্রোহ,মানহানি, জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা ইত্যাদি অভিযোগ আনার প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, ভারতীয় সংবাদমাধ্যম নিরপেক্ষ নয়, পক্ষপাতদুষ্ট। তবু ভরসার কথাটি এই যে, কেউ হলুদ সাংবাদিকতা, গৈরিক সাংবাদিকতা, উদ্দেশ্যমূলক সাংবাদিকতা সহ বিভিন্ন বিশেষণে সংবাদমাধ্যমকে ভূষিত করলেও, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের মৌলিক যে কাজ, অর্থাৎ ক্ষমতার উদ্দেশে সেই অমোঘ প্রশ্ন ‘রাজা তোর কাপড় কোথায়’ বলার সংখ্যা ক্রমক্ষীয়মান হয়ে এলেও, আজও তা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায়নি।