পদ্ম পাল্লা ভারী হলেও পুরীর ঐতিহ্যই মোদি-সম্বিতের কাঁটা!!

এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

অনলাইন প্রতিনিধি :-বাঙালি ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে পুরী একটি আবেগ।আর পুরী মানেই ‘জগন্নাথ ধাম’। শুধু বাঙালিরাই নয়, গোটা দেশ থেকে এমনকী সারা বিশ্ব থেকেই সারাবছর পুরীতে বহু মানুষের আসা-যাওয়া লেগে থাকে। একদিকে পুরীর অসাধারণ সমুদ্র সৈকত, অন্যদিকে জগন্নাথ মন্দির। দুটোই গোটা পৃথিবীর মানুষের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।ফলে একসাথে ‘রথ দেখা এবং কলা বিক্রি করা’ এই মানসিকতা থেকে পুরীতে সারা বছর মানুষের ভিড় লেগে থাকে।এখানে জগন্নাথ দর্শনের সাথে সাথে সমুদ্র সৈকতে আনন্দ উপভোগ, অর্থাৎ ‘তীর্থ যাত্রা ও বিনোদন’ দুটোই একসাথে। অনেকটা বর্তমান আধুনিক বাজার ব্যবস্থার মতো।একটা ক্রয় করলে আরেকটা ফ্রী। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘বাই ওয়ান গেট ওয়ান’।তবে জনমনে একটি কথা খুব প্রচলিত আছে, তা হলো জগন্নাথদেব না ডাকলে নাকি তার দর্শন পাওয়া যায় না। এহেন পুরী গোটা দেশের কাছে

আকর্ষণের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রবিন্দু, আর তা শুধু ধর্মীয় কারণে নয়, রাজনৈতিক দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ওড়িশার ২১টি লোকসভা নির্বাচন ক্ষেত্রের মধ্যে ‘পুরী’ একটি। প্রথমে কংগ্রেস দলের আধিপত্য থাকলেও, গত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে পুরী স্থানীয় শাসক দল বিজু জনতা দলের দখলে। ১৯৯৮ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত এই কেন্দ্রের সাংসদ ছিলেন বিজেডির ব্রজ কিশোর ত্রিপাঠি। আর ২০০৯ সাল থেকে এই কেন্দ্রের সাংসদ রয়েছেন বিজেডির প্রবীন নেতা পিনাকী মিশ্র। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে পুরী কেন্দ্র থেকে ৫ লাখ ৩৮ হাজার ৩২১ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছিলেন বিজেডি’র পিনাকী মিশ্র। মাত্র কয়েক হাজার ভোট কম পেয়ে (শতাংশের হিসাবে মাত্র ১%) দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা এবং দলের জাতীয় মুখপাত্র ডা. সম্বিত পাত্রা। তাঁর প্রাপ্ত ভোট ছিল ৫ লাখ ২৬ হাজার ৬০৭ ভোট। মাত্র ৪৪ হাজার ৭৩৪ ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থানে ছিলেন কংগ্রেস প্রার্থী সত্য প্রকাশ নায়েক। ফলে পুরী কেন্দ্রে রাজনৈতিক দলগুলির বর্তমানে কার কতটা শক্তি, তা নতুন করে বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। পুরী লোকসভার অন্তর্গত সাতটি বিধানসভা রয়েছে। সেগুলি হল পুরী, ব্রহ্মগিরি, সত্যবাদী, পিপিলি, চিলিকা, রানপুর ও নয়াগড়। এই সাতটি বিধানসভার মধ্যে পুরী ও ব্রহ্মগিরি বিজেপির দখলে, বাকি পাঁচটি বিধানসভা বিজেডির দখলে। ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে ‘পুরী’ কেন্দ্রে বিজেপি পুনরায় তাদের জাতীয় নেতা এবং দলের মুখপাত্র সম্বিত পাত্রাকে টিকিট দিলেও ওড়িশার ক্ষমতাসীন দল বিজেডি এবার টিকিট দেয়নি পুরীর বর্তমান সাংসদ পিনাকী মিশ্রকে। তাঁর বদলে দল টিকিট দিয়েছে অরূপ পট্টনায়েককে। জানা গেছে, অরূপ পট্টনায়েক নাকি মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়কের পরামর্শদাতা প্রাক্তনন সচিব ভিকে পান্ডিয়ানের পছন্দের প্রার্থী। সেই পান্ডিয়ান, যার নানা দুর্নীতি এবং অপকর্মের বিরুদ্ধে ওড়িশার একটা বড় অংশের জনগণ ক্ষোভে ফুঁসছে। বিজেডিপ্রার্থী অরূপ পট্টনায়েক মুম্বাইয়ের প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার। অভিযোগ, তাঁর টিকিট পাওয়ার ক্ষেত্রে অনৈতিক লেনদেন হয়েছে বলে স্থানীয়দের অভিমত। অপরদিকে, ওড়িশায় নির্বাচনের আগেই পুরী কেন্দ্রে বড় ধাক্কা খেয়েছে কংগ্রেস দল। পুরীতে কংগ্রেস প্রথমে টিকিট দিয়েছিল ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনের কংগ্রেসের বিজিত প্রার্থী বিশিষ্ট সাংবাদিক সুচরিতা মোহান্তিকে। শ্রীমতী মোহান্তি স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং প্রাক্তন প্রবীণ কংগ্রেস নেতা ব্রজমোহন মোহান্তির কন্যা। যিনি ১৯৮০ এবং ১৯৮৪ সালে দু’বার লোকসভায় পুরীর প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনে সুচরিতা মোহান্তি পুরী কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১৮.৫০ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন। ২০১৯ সালে কংগ্রেস ওই কেন্দ্রে সুচরিতাকে টিকিট না দিয়ে সত্য প্রকাশ নায়েককে প্রার্থী করে। ওই বছর কংগ্রেস পুরীতে মাত্র ৩.৯৪ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থানে নেমে যায়। এ বছর কংগ্রেস আবার সুচরিতা মোহান্তিকে টিকিট দিলেও, সুচরিতা দলের টিকিট ফিরিয়ে দিয়েছেন দলের বিরুদ্ধে আর্থিক অনুদান না দেওয়ার অভিযোগ তুলে। নির্বাচনি প্রচারের জন্য দলের হাইকমান্ডের তরফ থেকে কোনও রকম তহবিল বরাদ্দ করা হয়নি-এই অভিযোগ
তুলে সুচরিতা নির্বাচনি লড়াইয়ের ময়দান থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। বাধ্য হয়ে শেষমেষ দল জয়নারায়ণ পট্টনায়েক নামে অন্য একজনকে পুনরায় টিকিট দিয়েছে। ফলে পুরীতে লড়াই মূলত বিজেডি এবং বিজেপির মধ্যে।কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ইতিহাসের বর্ণনা অনুযায়ী পুরী হিন্দুদের অন্যতম পবিত্র তীর্থক্ষেত্র এবং পুরীর ভোটারদের ৯৫ শতাংশ হিন্দু হলেও পুরীর মাটিতে লোকসভায় আজও দাঁত ফোটাতে পারেনি বিজেপি। এখানে বামেরা জিতেছে, কংগ্রেস জিতেছে, জনতা পার্টি জিতেছে, আর বিজেডি-তো গত দুই দশক ধরে পুরী নিজেদের দখলেই রেখে দিয়েছে। কিন্তু বিজেপি নৈব নৈব চ। ২০১৪ সালে প্রবল মোদি হাওয়ায় ভর করেও পুরী জয় হয়নি বিজেপির। সেইবার তৃতীয় স্থানে থামতে হয়েছিল। ২০১৯ সালে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এলেও সামান্য ভোটের ব্যবধানে জয় অধরাই থেকে যায়। এবার পরিস্থিতিটা একটু ভিন্ন মনে হলো। নানা কারণে নবীন সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণের একটা বড় অংশের ক্ষোভ, বিশেষ করে মুখ্যমন্ত্রী নবীনকে একেবারে হাতের মুঠোর ভিতরে নিয়ে রাখা তাঁরই একান্ত সচিব ভি কে পান্ডিয়ানের নানা দুর্নীতির কারণে তৈরি হওয়া ক্ষোভকে হাতিয়ার করে এবার ‘পুরী’ জয় করতে আদাজল খেয়ে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন বিজেপি প্রার্থী ডা. সম্বিত পাত্রা। জয়ের ব্যাপারে খুবই আশাবাদী তিনি। পুরীতে সব দলেরই প্রচার জগন্নাথময়। তাঁর নামে জয়ধ্বনি করেই নেতা নেত্রীদের ভাষণ শুরু এবং শেষ হয়। পুরীতে এসে যে হোটেলে উঠেছি, সেই হোটেলের ম্যানেজারের নাম বাদল আইচ। তিনি পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা হলেও, দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে পুরীতেই চাকরি করছেন। তাঁর দাবি এবার পুরীতে বিজেপি জয়ী হবে। কারণ জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, বিজেডি সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ জন্মেছে। নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধির জন্য তেমন কিছু করেনি বর্তমান সরকার। পর্যটনের উন্নতি হয়নি। মানুষের হাতে তেমন কোনও কাজ নেই। পুরীতেই জন্ম যুবক রিঙ্কু নায়েক এবং জয়ন্ত পট্টনায়েকের। এদের একজন পুরীর স্বর্গদ্বারের কাছে চায়ের দোকান চালান, অন্যজন একটি মিষ্টির দোকানে কাজ করেন। তাদের মুখেও ক্ষোভের সুর শোনা গেল। আবার পুরীর দিগন্ত রোডের বাসিন্দা অভিনাশ মিত্র শোনালেন অন্য কথা। তাঁর দাবি, পুরীর জন্য নবীন পট্টানায়ক যা করেছেন, তার তুলনা হয় না। ফলে এখানে শঙ্খ (দলীয় প্রতীক) জিতবে। আগের তুলনায় মার্জিন কিছু কমতে পারে। এর বেশি কিছু নয়। তবে দিনভর পুরীতে ঘুরে মনে হল, জাতীয় সংবাদ মাধ্যমে ঝড় তোলা বিজেপি মুখপাত্র ডাঃ সম্বিত পাত্রার পাল্লা এবার ভারী হলেও, লড়াইটা ও শেষপর্যন্ত মোদি বনাম নবীনের মধ্যেই হবে বলে মনে হয়। শুধু তাই নয়, পুরীর ভোটের ফলের যে ঐতিহ্য সেটাই মোদি এবং সম্বিতের কাঁটা। এই লড়াইয়ে শেষ হাসি কে হাসবে তা আগামী ৪ জুনই স্পষ্ট হবে। পুরীতে লোকসভা ও বিধানসভার ভোট হবে ষষ্ঠ পর্যায়ে আগামী ২৫ মে। এদিন ওড়িশার কটক, ভুবনেশ্বর সহ আরও তিনটি, অর্থাৎ মোট ৬ টি লোকসভা কেন্দ্রে এবং ওই লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত বিধানসভাগুলিতে ভোট গ্রহণ হবে। ফলে জগন্নাথ ধামে রাজনৈতিক লড়াই এবার বেশ চমকপ্রদ হতে চলেছে, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

Dainik Digital

Share
Published by
Dainik Digital

Recent Posts

এ কে-৪৭ ও প্রচুর কার্তুজ সহ ৬ বৈরী ধৃত মিজোরামে, চাঞ্চল্য!!

অনলাইন প্রতিনিধি:- বাংলাদেশ থেকে কাঞ্চনপুর মহকুমার ভারত- বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে মিজোরামে যাওয়ার পথে মামিত জেলার…

21 hours ago

ফাইফরমাশ খাটছেন টিএসআর জওয়ানরা !!

অনলাইন প্রতিনিধি :- নিরাপত্তার কাজে নয়, টিএসআর জওয়ানদের খাটানো হচ্ছে আর্দালি হিসাবে। পুলিশ আধিকারিকদের ও…

22 hours ago

ইন্ডিগো আরও একটি দিল্লীর বিমান চালু করছে!!

অনলাইন প্রতিনিধি :- ইন্ডিগো আগরতলা- দিল্লী রুটের উভয় দিকে যাতায়াতে আরও একটি বিমান চালু করছে।…

22 hours ago

ইন্দ্রপ্রস্থে ভোট!!

দিল্লীর বিধানসভা ভোট নিয়ে সরগরম দিল্লী। দিল্লীতে এবার এক আঙ্গিকে বিধানসভা ভোট হচ্ছে। গত পরিস্থিতির…

22 hours ago

বহিঃরাজ্যে গেল “ধানি লঙ্কা”ওরফে ধান্না মরিচ!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-ত্রিপুরায় উৎপাদিত" অর্গানিক বার্ড আই চিলি " স্হানীয় ভাষায় যাকে বলা হয় ধানি…

2 days ago

কুম্ভ ইকনমি

২২জানুয়ারী,২০২৪।এক বছরের ব্যবুধানে ২০২৫ সালের ১৩ জানুয়ারি।গত বছরের মেগা ইভেন্টের আসর বসেছিল অযোধ্যায়। এবার মেগা…

2 days ago