পুনর্গঠনে মনোনিবেশ!!
প্রকাশ্যে ইভিএমের কারচুপির কথা বললেও কার্যত দলকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে সংগঠন মজবুত করা ছাড়া রাস্তা খোলা নেই সেটা দ্য গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টি কংগ্রেস খানিকটা দেরিতে হলেও মেনে নিতে শুরু করেছে। মূলত হরিয়ানা এবং মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনে হারের পরই এই বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব হাইকমাণ্ড।গত ২৯ নভেম্বর কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক বসেছিল ২৪ আকবর রোডে।প্রায় সাড়ে চার ঘন্টারও বেশি সময় ধরে চলা এই বৈঠকে কংগ্রেস সভাপতি থেকে শুরু রাহুল গান্ধী ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধী সকলেই একটা বিষয়ে জোর দিয়েছেন যে,দলকে মাথা তুলে দাঁড়াতে হলে নিজেদের আরও অনেক বেশি গুছিয়ে তৈরি করে তারপর ভোটে নামতে হবে।অর্থাৎ দিল্লী থেকে হাইকমাণ্ড ছুটে আসবে,আর রাজ্যনেতারা হাইকমাণ্ডের মুখনিঃসৃত বুলিতে ভোটের বাজনা বাজাবেন- ভ এই প্রথাগত পথ চলা যে বর্তমানে অচল, বরং জাতীয় ইস্যু আর দিল্লীর নেতাদের উপর অতিরিক্ত দায়ভার না চাপিয়ে রাজ্যনেতারা রাজ্যের ইস্যুতে যে এখন থেকে ভোটের প্রস্তুতি নেবেন এবং নির্বাচনে লড়বেন সেটা কংগ্রেস নেতৃত্ব পরিষ্কার করে দিয়েছেন। অর্থাৎ রাজ্য সংগঠনকে নিজের পায়ে ভর করেই ভোটে লড়তে হবে।এই ছাড়া কখনও কাঙিক্ষত সাফল্যে পৌঁছতে পারবে না কংগ্রেস। যদিও সাম্প্রতিকালে অনুষ্ঠিত একাধিক নির্বাচনের ফলাফলের বিষয় বৈঠকে পর্যালোচনায় স্থান পেয়েছে। বিশেষ করে হরিয়ানা এবং মহারাষ্ট্রের নির্বাচনি পরাজয় যে কংগ্রেসের জন্য একটা বড়সড় ধাক্কা সেটা নিয়েও কংগ্রেস ম্যানেজাররা বৈঠকে দীর্ঘ মতবিনিময় করেছেন। এক্ষেত্রে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে প্রতিটি নির্বাচনে ইভিএমে কারচুপি একটা বড় ভূমিকা নিয়েছে-সেই অভিযোগও তুলেছেন খাড়গে থেকে শুরু করে দলের প্রায় সব শীর্ষ নেতৃত্ব।কিন্তু ইভিএমই যে দলের খারাপ ফল বা পরাজয়ের একমাত্র কারণ নয়, আর পাঁচটা কারণের মতো ইভিএমে অনিয়ম সম্পর্কিত অভিযোগ অন্যতম একটি কারণ-সেই কথাটিও দলের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে আলোচিত হয়েছে।নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা কিংবা ইভিএমের স্বচ্ছতা ও পবিত্রতা নিয়ে কংগ্রেস কিংবা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ নতুন নয়। কিন্তু শুধুই নির্বাচনি কারচুপি ও কমিশনের পক্ষপাতদুষ্ট মনোভাবকে দোষ দিয়ে যে লাভ হবে না,
কংগ্রেসের নিজের মধ্যেও যে প্রচুর গাফিলতি রয়েছে, রয়েছে অন্তর্কলহ এবং আত্মঘাতী খেলা-সেই বাস্তবতাটুকুও এখন স্বীকার করছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। কারণ লোকসভা ভোটে কংগ্রেস উৎসাহব্যঞ্জক ফল করার পর, সেখানেই যখন বিধানসভা নির্বাচন হচ্ছে সেখানেই একের পর এক ধাক্কা খাচ্ছে শতবর্ষ প্রাচীন দলটি।অর্থাৎ বিসমিল্লায় যে কোথাও গলদ আছে সেটা আর অস্বীকারের সুযোগ নেই।কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কংগ্রেসের ভেতরকার এই আত্মঘাতী খেলা এবং কলহ তো নতুন ঘটনা নয়। এতগুলি বছর ধরে তো রাজ্যে রাজ্যে এসবই দেখে আসছেন দলীয় কর্মী-সমর্থকরা।যে কারণে ক্ষোভে, দুঃখে, অভিমানে অনেক নিষ্ঠাবান কর্মী সমর্থকই অনিচ্ছা সত্ত্বেও শিবির বদল করে আজ গেরুয়া শিবিরে অবস্থান করছেন।কিন্তু এতদিন এই কথাগুলি কেন মনে পড়েনি কংগ্রেস নেতাদের। কংগ্রেসের সংগঠনে ঘাটতি, দলকে মাথা তুলে দাঁড়াতে হলে কঠোর ব্যবস্থা, দলীয় সংগঠনে বড়সড় রদবদল, দলে শৃঙ্খলা, অনুশাসন-এই বিষয়গুলো তো বহুচর্চিত। কিন্তু কংগ্রেস হাইকমাণ্ড তথা কংগ্রেস সভাপতিরা যারা বিভিন্ন সময়ে দলের নেতৃত্বে ছিলেন তারা কেন চুপটি মেরে বসেছিলেন?হরিয়ানায় ভোটের আগে ভূপিন্দর হুডা, কুমারী শৈলজা, সুরজেওয়ালার পারস্পরিক বয়ানবাজি তো সেইদিনের ঘটনা। এর আগে মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থানে তো একই ঘটনা ঘটে গেছে।কিন্তু এতকাল কংগ্রেস হাইকমাণ্ড প্রতিটি নির্বাচনের পরই চিন্তন শিবির অথবা ব্রেন স্টর্মিং সেশন বা মস্তিষ্ক মন্থন শিবির করে গেছেন।যার নীট ফল ছিল জিরো। এখন যখন সিডব্লুসি বৈঠকে ইভিএম কারচুপি, ব্যালট পেপারে ভোট ফিরিয়ে আনা,কিংবা কমিশনের পক্ষপাত ভূমিকার পাশাপাশি দলের জন্য কঠোর দাওয়াইয়ের কথাও নেতৃবৃন্দ বলছেন, তখন বুঝতে হবে আসল ক্ষতটা কোন জায়গায় সেটা দেরিতে হলেও বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না তাদের। কিন্তু প্রকাশ্যে তা স্বীকার করতেই যত সমস্যা। আসলে কর্ণাটকের বেলগাঁওতে ২৬ ডিসেম্বর মহাত্মা গান্ধীর কংগ্রেস সভাপতি পদে দায়িত্বভার গ্রহণের শতবর্ষ পালনের দিনটিকে সামনে রেখে ইভিএমের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী প্রচার আন্দোলনের শুরুর কথা বললেও,এও যে পরোক্ষে দলে পরিবর্তন আনার প্রস্তুতি, সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।দলের পরাজয় সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে একথা হজম করা নেতৃত্বের সম্ভব হচ্ছে না বলেই কৌশলে কঠিন দাওয়াইয়ের এই বিকল্প পন্থা নিতে হচ্ছে কংগ্রেসকে।