পুরোনো আড্ডার খোঁজে

 পুরোনো আড্ডার খোঁজে
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

ত্রিপুরার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহের কোয়ার্টারে বসত শনিবাসরীয় আড্ডা । সেই আড্ডাতে অবাধ বিচরণ ছিল পণ্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ শর্মার ( সবার প্রিয় গঙ্গাদা ) । উনি ছিলেন রাজপণ্ডিত , দার্শনিক , একাধারে আড্ডার মধ্যমণি । শনিবারের আড্ডায় উনি না এলে শচীনবাবু রিকশা পাঠিয়ে দিতেন । পুরাতন মোটর স্ট্যান্ড এলাকায় জাতীয় মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের পাশে ছিল বীরেশ চক্রবর্তী মহাশয়ের মর্ডান বৈদিক মেডিসিন । উনি আবার ‘ ত্রিপুরা ‘ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন । পত্রিকাটি ওনার বলিষ্ঠ এবং ক্ষুরধার লেখনীতে তখনকার সময় পাঠকদের অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছে । সেই ঔষধালয়ে সন্ধ্যায় হাজির হতেন তুখোড় আড্ডাপ্রিয় সুখময় সেনগুপ্ত ( তখনও মুখ্যমন্ত্রী হননি ) , তড়িৎমোহন দাশগুপ্ত , অমর গুপ্ত এবং আড্ডার চুড়ামণি সেই গঙ্গাদা ।সুখময়বাবু আর গঙ্গাদার আড্ডার আলোচনা মাঝে পান খাওয়ার নেশা চড়ত । হীরালাল দে মহাশয়ের ‘ দিলখোস ‘ পানভাণ্ডার থেকে বিভিন্নরকম মশলা আর ওই সময়ের জনপ্রিয় তারক গুপ্তের জর্দা মাথা সুগন্ধী – পান সোনালি ও রূপালি তবকে মুড়ে সেই আড্ডায় আসত । আড্ডায় রাজনৈতিক চর্চাই হতো বেশি । আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য আড্ডার কথা না বললেই নয় । তন্মধ্যে শকুন্তলা রোডে নেপালদের সমুদ্রণ – প্রেস , মাণিক্য প্রেসের দুলাল রায় চৌধুরী ও বিশেষ করে দৈনিক সংবাদ পত্রিকার সম্পাদক তথা ত্রিপুরা সংবাদজগতের প্রাণপুরুষ ভূপেন্দ্র চন্দ্ৰ দত্ত ভৌমিক মহাশয়ের সাহিত্য – সংস্কৃতি বিষয়ক আড্ডা । ওইসব আড্ডায় যেমন ত্রিপুরার নবীন – প্রবীণ লেখক সাংবাদিকরা ভিড় জমাতেন ‘ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে ‘ , তেমনি ‘৭১ -এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সেদেশের অনেক কবি , সাহিত্যিক ও সাংবাদিক ( যারা আমাদের রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন ) দৈনিক সংবাদ অফিসের আড্ডায় নিয়মিত আসতেন । সবার উপস্থিতিতে সেসমস্ত জায়গাগুলো যেন প্রতিদিন জীবন্ত হয়ে উঠত । সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আড্ডার ধরনও পাল্টাতে থাকে । আড্ডা হবে অথচ চায়ের কাপে ঝড় উঠবে না , খাওয়াদাওয়া হবে না তা কি হয় ? আমাদের শহরবাসীরা খেতে ভালবাসেন । শহরের আনাচেকানাচে বা সিটি সেন্টারের সামনে গজিয়ে ওঠা ফাস্ট ফুডের দোকানগুলিতে ভিড় দেখলেই বোঝা যায় । আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা ও দোকানিদের তৈরি ফাস্ট ফুডের হরেকরকম রেসিপি বিন্দাস খেয়ে যাচ্ছে । অতীত দিনের নির্মলা রেস্টুরেন্টের বিরিয়ানির কথা মনে পড়ে । স্বাদে – গন্ধে যা ছিল অতুলনীয় । যারা একবার খেয়েছে তারা ‘ নির্মলা’র প্রেমে পড়ে স্বাদগ্রহণের অতৃপ্ত বাসনায় একবার হলেও আখাউড়া রোডের ধারে আড্ডার ছলে নির্মলাতে ঢুঁ মেরেছেন । রেস্টুরেন্ট বলতে তখন ছিল নির্মলা , অশোকা আর ও.কে। তবে বিরিয়ানি তৈরিতে নির্মলা অনেকটাই এগিয়ে । অশোকার কাটলেটের কথাও ভুলি কী করে ! ওদের চিকেন বিরিয়ানিও ছিল অসাধারণ । এখন তো কোনও প্রতিষ্ঠানের পণ্য বিক্রিতে বিজ্ঞাপন দিতে হয় , যাকে বলে মার্কেটিং । মুহূর্তে মুহূর্তে ফেসবুক – ট্যুইটার ইনস্টাগ্রামে নিত্যনতুন রেসিপির ভিডিও পোস্ট করে ভাইরাল হয়ে যায় । তখন সেসবের দরকার হয়নি । জিনিস ভাল হলে খদ্দেররা দাম দিতে পিছপা হতো না ।একবার ভাল লাগলেই ব্যস । ব্র্যান্ড হয়ে যেত । এখন তো চারিদিকে হোটেল রেস্তোরাঁর ছড়াছড়ি । ইঁদুরদৌড়ের প্রতিযোগিতার বাজারে অশোকা তার গ্ল্যামার এখনও অক্ষুণ্ন রাখতে পেরেছে । কথায় বলে না , ‘ মরা হাতি লাখ টাকার সমান’— এমন আর কী । ওসব রেস্তোরাঁগুলোতে সব ঋতুতেই জমিয়ে চলত আড্ডা । – মাতৃভাণ্ডারের মুখরোচক সিঙারার কথা মনে আছে ? শীতের মরসুমে ফুলকপি , নারকেল , কিশমিশ আর বাদাম সহযোগে তৈরি হতো সুস্বাদু সিঙারা । এখানে ময়রার কারিগরি কৌশলই ছিল মুখ্য । দাম মাত্র দশ পয়সা । মাতৃভাণ্ডারের কাঠের তৈরি দোতলায় এক পেয়ালা ধোঁয়া ওঠানো চায়ের সঙ্গে গরমাগরম সিঙারার যুগলবিন্দতে আড্ডার মেজাজটা সপ্তম সুরে উঠে যেত । কালে দোকানের সিঙারাটি উদয়পুরের মাতাবাড়ির পেঁড়ার মতো শহরবাসীর কাছে বিশেষ পরিচিতি পেয়ে যায় । সেই মাতৃভাণ্ডার আর ও.কে রেস্টুরেন্টকে ঘিরে থাকত অতীত দিনের বিখ্যাত সব ফুটবলারদের জম্পেশ আড্ডা । রণজিৎ দাস , রঞ্জিত দেববর্মা , উৎপল দেববর্মা , বিষ্ণু দত্ত , দুলাল চক্রবর্তী , প্রতাপ দেববর্মা ও চিন্তাবাহাদুরের মতো সেরা ফুটবলাররা সেই আড্ডায় সামিল হতেন । এসবই এখন অতীত দিনের ইতিহাস । মাতৃভাণ্ডারের উত্তরদিকে ছিল মেসার্স জিসি সাহা অ্যান্ড সন্স । এখনও আছে , কিন্তু সাইনবোর্ডটি আর নেই । সেই দোকানে নানারকম সুগন্ধী ও মশলাযুক্ত সাঁচি , বাংলা ও বেনারসি পান পাওয়া যেত । সান্ধ্যকালীন আড্ডায় পান খেতে আসতেন এমবিবি কলেজের স্বনামধন্য ইংরাজি সাহিত্যের অধ্যাপক শ্রদ্ধেয় বামাপদ মুখোপাধ্যায় , বিশিষ্ট নাট্যকার প্রশান্তকুমার গাঙ্গুলি , বীরচন্দ্র লাইব্রেরির গ্রন্থাকার ও বিশিষ্ট লেখক রমাপ্রসাদ দত্ত ওরফে পল্টুদা , প্রখ্যাত চিত্র সাংবাদিক রবীন সেনগুপ্ত এবং শহরের বিশিষ্ট নাগরিক রসিক কর্তা । সেই আড্ডায় দেখেছি পান চিবুতে চিবুতে বামাপদ স্যার প্রশান্ত গাঙ্গুলিকে ওথেলো নাটকে ওথেলোর সংলাপ কী করে নিখুঁত ভাবে উচ্চারণ করতে হবে তা বুঝিয়ে দিতেন । আজ আর কেউ বেঁচে নেই । কিন্তু সেই দোকানের আড্ডার ধারাবাহিকতা আজও বজায় আছে । পঞ্চাশ থেকে সত্তরোর্দ্ধ বয়সের চুলে পাক ধরেছে এমন লোকেরা আজও সেই জায়গায় আড্ডা দিয়ে যাচ্ছেন । এস ওয়াজেদ আলির ভাষায় বলতে ইচ্ছে করে , ‘ সেই ট্র্যাডিশন আজও সমানে চলেছে , তার কোথাও কোনও পরিবর্তন হয়নি । ‘ এখানে কেউ কাউকে বুড়ো ভাবেন না । সবাই যে ‘ এভারগ্রিন – চিরসবুজ ‘ ।এবার আসি শহরের প্রাণকেন্দ্র সূর্য রোডের আড্ডায় । এককথায় আগরতলায় আড্ডাপ্রেমীদের চৌরঙ্গী । ওই রাস্তাটি সান্ধ্যকালীন আড্ডায় শহরের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী , বিভিন্ন পেশার লোক , কলেজ ছাত্র ও সিনেমাপ্রেমীদের আগমনে গিজগিজ করত । দাঁড়িয়েই চলত ঘণ্টার পর ঘণ্টা ম্যারাথন আড্ডা । হলে ভাল ছবির পোস্টার পড়লে ভিড় কয়েকগুণ বেড়ে যেত । রাস্তাটিতে পানদোকান , টি – স্টল ও তেলেভাজার দোকান ছিল বেশি । এর মধ্যে জনপ্রিয় ছিল কালীমোহনের চপের দোকান । আড্ডায় কালীবাবুর চপ বিক্রি ছিল টপে । অনেকে আবার কাগজের ঠোঙা করে বাড়ি নিয়ে যেতেন । দোকানের ভিড় সামলাতে ওনাকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হতো । এমনই ছিল চপের কদর । আর চা দোকানগুলোতে চলত আড্ডাবাজদের বেঞ্চ – টেবিল দখলের লড়াই । নিজেদের বসার জায়গাটি পাকাপোক্ত করে চায়ের অর্ডার পড়ত , ‘ তিনটারে – পাঁচটা অথবা পাঁচটারে – সাতটা ‘ এমন । গভীর রাত পর্যন্ত চলত জমাটি আড্ডার আসর । তখন ছিল নয়টা – বারোটা শো । দোকানিদের বিক্রি – বাট্টাও খুব হতো । তখনকার দিনেও শহরের অ্যালকোহলিকদের জন্য দু’টি বার সমেত রেস্তোরাঁ ছিল । একটি রিজ অপরটি সৌরাষ্ট্র । এখন নেই । সেখানে বসে সুরাপান করার বন্দোবস্ত ছিল । অনেকে গেলাসে একটু – আধটু চুমুক লাগিয়ে দীর্ঘক্ষণ – পানবিলাসের আড্ডায় মজে যেতেন । কিন্তু কোনও দিন কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে বলে শহরবাসীর চোখে পড়েনি । এমনই ছিল সেদিনকার রেস্তোরাঁগুলোতে শৃঙ্খলা আর বিশেষ ম্যানাজারিয়েল ব্যবস্থা । আর এখন তো প্রভাতী দৈনিকের পাতায় কত কী দেখতে পাওয়া যায় ! পুরোনো দিনের সৌরাষ্ট্র হোটেলের দেওয়ালে সাঁটা বিবর্ণ সাইনবোর্ডটি এখনও তার কৌলিন্য আর আভিজাত্যের অহঙ্কার বহন করে চলেছে । হকার্স কর্নারের কায়েতের মিষ্টি পানভাণ্ডার এবং সৌরাষ্ট্র হোটেলের ঠিক নিচে মুরারীবাবুর সেই বিখ্যাত পানদোকানের কথা শহরবাসীর এখনও নিশ্চয়ই মনে আছে ? মুরারী ধর মুরারী বিহার থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে আগরতলায় এসে পানদোকান খোলেন । ওদের তিন প্রজন্মের ব্যবসা দোকানে বর্তমানে নতুন সাইনবোর্ড লাগালেও লোকে এখনও ‘ মুরারীর পান দোকান ‘ বলে জানে । উনি বেনারস থেকে সরাসরি পান অর্ডার দিয়ে আনতেন । সেই পান সম্পূর্ণভাবে খয়ের মেখে হরেকরকম মশলা ও বেনারসী জর্দা মিশিয়ে খিলিপান বানাতেন । যারা খেতেন , তাদের মুখে এবং শরীরে একটা আলাদা সুগন্ধ যেন ম – ম করত । সেই পান খাওয়ার নেশায় লোকেদের লাইন পড়ে যেত । প্রয়াত শঙ্কর দাস ( উনি তখনও আগরতলা পুরপরিষদের চেয়ারম্যান হননি ) পান খেতে মুরারীবাবুর দোকানে নিয়মিত আসতেন । ওনার দোকানের সামনে কিছু আড্ডাখোর লোক বাড়ি ফিরতে প্রায়ই দেরি করতেন । পথের দিকে চেয়ে চেয়ে এনাদের সতীলক্ষ্মীরা এক্কেবারে গরম কড়াইয়ের মতো তেতে থাকতেন । মুরারীবাবু এদের কয়েকজনকে বেশ ভালভাবেই চিনতেন । ফেরার পথে হরেকরকম মশলা সহযোগে সুর্তি দেওয়া রাংতার মোড়কে পান পুরে তাদের হাতে তুলে দিতেন । বাড়ি ফিরে পতিদেবটি অশনি সংকেতের আঁচ পেে পাংশুটে মুখে পকেট থেকে পানের খিলি বের করতেই আর যায় কোথায় ! অমনি কেল্লাফতে । যেন প্রচণ্ড মেঘগর্জনের পর ধরাধামে বৃষ্টি নেমে এসেছে । পতিপরমেশ্বরের মুখে তখন একটা বিখ্যাত হিন্দি ছবির গানের সুর , ‘ পান খায়ে সাঁইয়া , হামারো , শ্যাওলী সুরতিয়া হোঁট লাল লাল ….। ‘ এমনই ছিল মুরারীবাবুর সুর্তি দেওয়া তাম্বুল – পিরিতির জাদু ! এসমস্ত দোকানগুলো বা আড্ডার স্থানগুলো আগরতলা শহরবাসীর কাছে এখনও ইতিহাস হয়ে আছে । কিন্তু সেইসব আড্ডার পুরোনো স্মৃতিমেদুর গ্রামোফোনের ডিস্ক অনেকের কানের কাছে যেন আজও অনবরত বেজে চলেছে ।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.