প্রকল্পেও নাম বদল

 প্রকল্পেও নাম বদল
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

দুনিয়া জুড়ে প্রায় সর্বত্রই নানা কারণে জায়গার নাম, শহরের নাম, ভবনের নাম, প্রকল্পের নাম বদল করা হয়ে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই নাম বদলের পেছনে যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত কারণও থাকে। কিন্তু ভারতের মতো দেশে নামবদলের ঘটনা এক ধরনের ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও এই ধরনের প্রবণতা নতুন কোনও ঘটনা নয়। তবে সাম্প্রতিক ভারতে এই নাম বদলের প্রবণতার যে হিড়িক পড়েছে এ নিয়ে ইতিহাসবিদ থেকে শুরু করে গবেষক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সকলেই উদ্বিগ্ন। আসলে এ দেশে নামবদলের পেছনে যতটা না যুক্তি বা প্রয়োজন কাজ করে, তার চেয়ে বেশি কাজ করে কট্টরপন্থী রাজনৈতিক মানসিকতা। এতে ইতিহাস যেমন বদলে যায়, তেমনি সামাজিক ভারসাম্যও অনেক ক্ষেত্রে নষ্ট হয়। এর ফলে অনুভূতিতে যেমন আঘাত লাগে, তেমনি আবেগের জায়গাটিতেও নিঃসন্দেহে কোনও না কোনওভাবে প্রভাব ফেলে যায়। প্রসঙ্গের অবতারণা করতে হল এই কারণে, সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার পূর্বতন ইউপিএ সরকারের আমলের খাদ্য সুরক্ষা প্রকল্পের নাম বদলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং কেন্দ্রীয় কেবিনেটে তা অনুমোদনও পেয়েছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নিয়েছে খাদ্য সুরক্ষা প্রকল্পের নাম বদলে এবার থেকে নতুন নাম হবে প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা। ২০১৩ সালে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইনের মাধ্যমে এতদিন দেশের গরিবদের সস্তায় চাল- গম বন্টন করতেন রেশন দোকানের মাধ্যমে। কোভিডের সময় কেন্দ্রের মোদি সরকার খাদ্য সুরক্ষা আইনের আওতায় থাকা ৮১ কোটি মানুষকে পুরোপুরি বিনা খরচে বাড়তি রেশন বিলি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তখন এর নাম দেওয়া হয় প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা। লক্ষণীয় হল, গত পক্ষকাল আগে কেন্দ্রীয় সরকার আবারও সিদ্ধান্ত নেয় ২০২৩ পুরো চলতি বছরেও খাদ্য সুরক্ষার আইনে ৮১ কোটি গরিব মানুষকে পুরোটাই বিনামূল্যে রেশন সরবরাহ করা হবে। অর্থাৎ এতদিন যে চাল তিন টাকা দরে এবং গম / আটা দুই টাকা দরে রেশনের মাধ্যমে বন্টন করা হত সেটা এখন থেকে ভোক্তাদের বিলি করা হবে কিন্তু কোনও অর্থ নেওয়া হবে না। এর মানে দাঁড়াল প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনায় বাড়তি রেশন দেওয়ার যে ব্যবস্থা চালু হয়েছিল সেটা এখন বন্ধ হবে। পরিবর্তে জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা প্রকল্পের নামই বদলে দিয়ে এখন থেকে প্রকল্পের নাম হবে প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা। ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের আগে পূর্বতন জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা প্রকল্পের মধ্যে নিখরচায় রেশন বিলির মাধ্যমে পুরো রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যেই এই কৌশল নেওয়া হয়েছে বলে ইতিমধ্যেই মোদি সরকারের দিকে আঙুল তুলেছে বিরোধী দল কংগ্রেস।
আসলে কেন্দ্রীয় সরকারের পূর্বে চালু বিভিন্ন প্রকল্পের নাম বর্তমান সরকার বদলে দিয়ে তাতে প্রধানমন্ত্রীর নন জুড়ে দেওয়ার এই রেওয়াজ নতুন কোনও ঘটনা নয়। এর আগে ইন্দিরা আবাস যোজনার নাম বদলে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা করা হয়েছে। ফসল বিমা প্রকল্পের নাম মোদি সরকারের জমানায় হয়ে গেছে প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা। গরিব পরিবারে নিখরচায় রান্নার গ্যাসের সংযোগ প্রকল্পের নাম করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী উজ্জ্বলা যোজনা। ইন্দিরা গান্ধী হন মাতৃত্ব সহযোগ প্রকল্পের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী মাতৃত্ব বন্দনা যোজনা। কৃষকদের সারে ভর্তুকির প্রকল্পের নাম কর হয়েছে প্রধানমন্ত্রী ভারতীয় জন উর্বরক পরিযোজনা। জন ঔষধি প্রকল্পের নামেও জুড়ে দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর স্টিকার। ইংরেজি কবি-নাট্যকার শেক্সপিয়ারের রোমিও জুলিয়েট নাটকের একটি সংলাপ হল ‘হোয়াটস ইন আ নেইম’। এর বাংলা অর্থ হল – নামে কী আসে যায়। কিন্তু ভারতীয় রাজনীতিবিদদের কাছে সত্যি সত্যি, নামে অনেক কিছুই আসে যায়। তাই সব যুগে সব রাজত্বে এদেশে নাম বদলের জন্য মরিয়া চেষ্টা দেখা যায়। কিছু নাম বদলে দিলেই পুরানো আদর্শ ও ভাবনা যেমন অসত্য বা ফিকে হয়ে যায় না, তেমনি আদর্শহীন নাম মাহাত্ম্য প্রচার করে সমাজে স্থায়ী প্রভাব বেশি সময় ধরে রাখা যায় না। মূল কথা হল জনহিতকর কাজ। সেটাই লোকে মনে রাখে। ভারতীয় রাজনীতিতে নেতা ও প্রশাসকরা এই আপ্তবাক্য, যত তাড়াতাড়ি হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হবেন ততই তাদের মঙ্গল।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.