প্রতিবেশীর যাত্রাপথে!!

 প্রতিবেশীর যাত্রাপথে!!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ক্ষমতার বদল এবং সেই দেশে পুলিশের গুলীতে কিংবা সরকারের পতনের পর বীভৎস হিংসায় হাজার চার হাজার মানুষের মৃত্যুর পর গোটা ঘটনাটিকে সেই দেশের বুদ্ধিজীবীরা গণ অভ্যুত্থান বলিয়া অভিহিত করিতেছেন।কেহ কেহ আরও একটু আগাইয়া গিয়া বিপ্লব বলিতেছেন।এই সময়ে দেশ হইতে বিতাড়িত শেখ হাসিনার কোনও বক্তব্য প্রকাশ হইলে বা তার অনুগত যাঁহারা দেশে রহিয়া গিয়াছেন তাঁহাদের কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচি বা তৎপরতাকে প্রতিবিপ্লব বলিয়া চিহ্নিত করা হইতেছে।একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ পরিচালনার কাজে রহিয়াছে।তাহারা সকল কিছু সামলাইয়া দেশে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করিবে এমনই বলা হইয়াছিল।
পাঁচ আগষ্টে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর একমাসের অধিক সময় পার হইয়াছে। দেশটি অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে কোনওরকম স্থিতাবস্থার দিকে যাইতে পারিতেছে বলিয়া কাহারো মনে হইতেছে না।প্রতিবেশী দেশ বলিয়া নহে, বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিকের অভিমত ধরিয়াই বলা যায় যত দিন যাইতেছে ততই এই দেশটি এক চরম বিশৃঙ্খলার দিকে ধাবিত হইতেছে।শুধু রাজনৈতিক নয় সামাজিক ক্ষেত্রেও সেই বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য চরম আকার লইতেছে।শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগের পর যে সকল ঘটনাকে মোটা দাগে সামনে রাখিয়া কথা বলিতে হয় তার মধ্যে প্রথমেই রহিয়াছে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন।
হিন্দু মন্দির এবং সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর চিরাচরিত আঘাত নামাইয়া আনা হইলো।চিরাচরিত বলা হইতেছে কারণ,এই দেশে রাজনৈতিক বিপর্যয় কিংবা পালাবদল-সকল ক্ষেত্রেই আক্রমণের লক্ষ্য হইয়া যায় সংখ্যালঘু মানুষ।এমনিতেই এই উপমহাদেশে সংখ্যালঘু মানুষের স্বার্থ’ ইতর ব্যবধানে সর্বত্র অনাদৃত।এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এক চরম উদাহরণ হইয়া দাঁড়ায়। রাজনৈতিক পালাবদলের বাইরেও সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত।তিন বৎসর আগে বাংলাদেশে দুর্গাপুজোর সময়ে হিন্দু মূর্তির পায়ে কোরান শরিফ রাখিয়া দিয়া হিন্দুদের পুজোমণ্ডপ এবং বাড়িঘরে হামলা নামাইয়া আনা হয়। সেই সময়ে বাংলাদেশে শেখ হাসিনারই শাসন ছিল।
এককথায় শাসনে বা ক্ষমতায় যাহারাই থাকুক সংখ্যালঘু নির্যাতন যেন সেই দেশটির অন্ত্রে প্রবাহিত।তিন বৎসর আগে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের যাহারা মূর্তির পায়ে কোরান রাখিয়াছিল তাহাদের পরবর্তীতে চিহ্নিত করা হয়। মাদ্রাসায় শিক্ষিত যুবকেরা বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক ইসলাম প্রতিষ্ঠায় এই ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনাগুলি ঘটাইতে অগ্রণী ভূমিকা লইয়া থাকে।এই দফায় শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর তাই দেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিন্দু মন্দির পাহারায় মাদ্রাসার ছাত্রদিগকে দায়িত্ব ন্যস্ত করে।বলা যাইতে পারে শিয়ালকে ডাকিয়া মুরগি পাহারার কাজ দেওয়া হয়। ইহাতে বৃহৎ মন্দিরগুলি বাঁচিয়া গেলেও হিন্দুদের বাড়িঘরের মন্দির রক্ষা হয় নাই।হিন্দুদের বাড়িঘরে চোরাগোপ্তা হামলা ঘটিয়াই চলে।
প্রাতিষ্ঠানিক ইসলাম প্রতিষ্ঠা করিয়া বাংলাদেশ এবং আরবের ইসলামকে একাকার করিতে চাহে যাঁরা তাঁহারাও হাসিনার পতনের মুহুর্তকে মাহেন্দ্রক্ষণ ভাবিয়া লইয়াছে।কিন্তু এই অঞ্চলে ইসলাম যে মতে ঢুকিয়াছিল সেই ইতিহাস এবং ইসলাম ধর্মকে মানুষ যে রূপে গ্রহণ করিতেছে সেই বর্তমান পথের কাঁটা হইয়া দাঁড়াইতেছে। ফলে দেখা যায় হাসিনা উৎখাতের পর এই ইসলামিক গোষ্ঠীটি হিন্দু মন্দির ভাঙিতে যতটা আগ্রহী তাহার চাইতে কম আগ্রহী নয় মাজার ভাঙিবার অভিযানে। বাংলাদেশের বহু প্রাচীন মাজার উহারা ভাঙিয়া দিয়াছে অথচ অবিভক্ত বাংলার এই প্রান্তে বহিরাগত প্রচারকেরা মাজারে মাধ্যমেই ইসলাম প্রচার করিয়াছিলো বাংলার লোকাশ্রয়ী মুরশিদি মারফতি, ভাটিয়ালির আড়ালে এক সহজ পথের নির্দেশে।
একটি সমাজ কতটা নৈরাজ্যের অতলে ডুবিয়া গেলে নিজেদের ঐতিহ্য ভুলিতে বা অস্বীকার করিতে পারে ইহার তরতাজা উদাহরণ আজিকার বাংলাদেশ।দেশের অধিকাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মী। কিন্তু ইসলাম আজ তাহাদের মধ্যে মোট কতগুলি শাখা প্রশাখায় বিভক্ত হইয়া আছে তাহার সঠিক হিসাব নিশ্চয় করিয়া বলিতে পারেন না অন্তর্বর্তী সরকারের ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টা নিজেও। যতদূর জানা যায় বাংলাদেশে ইসলাম আজ শতধাবিভক্ত না হইলেও অর্ধ শতধা বিভক্ত হইয়া আছে।মোট ৫১ খানা দল নানাভাবে ইসলামকে ইসলাম বলিতে চাহিতেছেন। মূল দলগুলি হইলো দেওবন্দি, আহলে হাদিস, ব্রেলভি, জঙ্গী এবং জামায়েত ইসলামি। জামায়েত ইসলামির কোনও উপদল নাই।দেওবন্দির রহিয়াছে ১৩ মতের ১৩ খানা উপদল, আহলে হাদিসের ১৫ মতে ১৫ উপদল, ব্রেলভির ১৬ মতে ১৬ উপদল, জঙ্গী রহিয়াছে ছয় মতের ছয় দল। সর্বমোট ৫১ খানা দল বা উপদল মিলিয়া ইসলামকে নতুন করিয়া প্রতিষ্ঠা করিয়া সকল মুসল্লিমদের বেহেশতের পথ নির্দেশ করিতে চাহিতেছে।প্রসঙ্গত, একদিন আগে ঢাকার বাইতুল, মোকাররাম মসজিদে জুম্মাবারের প্রার্থনায় যে দল বা উপদল হামলা চালাইয়াছে তাহাদের উল্লেখ এই ৫১ দলের তালিকায় নাই।
হিন্দু সংখ্যালঘুরা যখন দুর্গোৎসবের আয়োজন করিতেছে বাংলাদেশের নানান অংশে তখন আগুন জ্বলিল পার্বত্য চট্টগ্রামে। দিঘিনালার আগুন ছড়িয়া পড়িয়াছে পাহাড়ের চারখানা জেলাতেই। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী বরাবরের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাসীরা অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাইতেছে, ড্রোন হইতে শুরু করিয়া নানান আধুনিক প্রযুক্তির অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া গিয়াছে বলিয়া দাবি করিয়াছে। অন্যদিকে একতরফা হামলার ঘটনায় পাহাড়ের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী উপজাতি অংশের মানুষ প্রাণভয়ে ঘর ছাড়িয়া জঙ্গলের পথে পথে আশ্রয় খুঁজিয়া বেড়াইতেছেন। প্রসঙ্গত, পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জনজাতি বনাম সেটেলার মুসলিমদের মধ্যেকার যে দ্বন্দ্ব, তা যখনই প্রকট হয় দেশের সামরিক বাহিনী সেটেলারদের পক্ষ অবলম্বন করিয়া থাকে। ইহাতে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটে, যার প্রভাব পড়িয়া থাকে প্রতিবেশী ত্রিপুরা রাজ্যের আন্তর্জাতিক সীমান্তে। এই ইতিহাস প্রাচীন এবং ত্রিপুরাবাসীর কাছে পরিচিত। অবাক হইবার বিষয় হইলো, তদারকি সরকারের জুম্ম ও জনগোষ্ঠীর একজন উপদেষ্টাও রহিয়াছেন।এই দফায় পার্বত্য চট্টগ্রামে হিংসার ঘটনায় তাঁর কিন্তু কোনও বিবৃতি নাই।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.