প্রত্যাবর্তন না পরিবর্তন??

এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত সূচি অনুযায়ী ১৬ ফেব্রুয়ারী রাজ্য বিধানসভার ত্রয়োদশ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ পর্ব শেষ হয়েছে। বিক্ষিপ্ত কয়েকটি ছোটখাটো ঘটনা বাদ দিলে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া ছিলো সুষ্ঠু, অবাধ এবং শান্তিপূর্ণ। দীর্ঘবছর পর প্রকৃত অর্থেই উৎসবের মেজাজে ভোট প্রত্যক্ষ করেছে রাজ্যবাসী। রাজ্য নির্বাচন দপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ইভিএম এবং পোস্টাল মিলিয়ে গড়ে ভোট পড়েছে ৮৯.৯৫ শতাংশ । এখন মূল প্রশ্ন হচ্ছে এই হাইভোল্টেজ নির্বাচনের ফলাফল কী হবে? প্রত্যাবর্তন নাকি পরিবর্তন? এই নিয়ে ভোটপর্ব শেষ হওয়ার পর থেকেই গোটা রাজ্যে জল্পনা তুঙ্গে উঠেছে। পাড়ার আড্ডা থেকে চায়ের দোকান, অফিস-কাছারি থেকে শুরু করে বাজার হাট- সর্বত্রই এখন শুধু এক আলোচনা। সর্বত্র কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে ভোটের ফলাফল নিয়ে নানা ব্যাখ্যা, নানা পর্যালোচনা। রাজনৈতিক দলগুলিও ভোটপর্ব শেষ হওয়ার পর রাত-দিন হিসাব নিকাশ করে চলেছে। বিভিন্ন জনমত সমীক্ষার সংস্থাগুলিও ব্যস্ত হিসাব মেলাতে। এই সবের মধ্যে সবথেকে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, শাসক-বিরোধী সব রাজনৈতিক দলই আত্মবিশ্বাসী। জনতার রায় ইভিএম বন্দি হয়ে এখন স্ট্রং রুমে। জয়ের হাসি শেষ পর্যন্ত কে বা কারা হাসবে, তা জানতে আগামী ২ মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে।
কিন্তু তার আগে ২০২৩ রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের গতিপ্রকৃতি, প্রত্যাবর্তন না পরিবর্তন ইত্যাদি নিয়ে একটি তুল্যমূল্য বিশ্লেষণ করা যেতেই পারে। সকলেই জানে ২০২৩ রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে পুরোপুরি ভিন্ন রাজনৈতিক সমীকরণে। স্বাধীনতার পর থেকে ২০২৩-এর আগে পর্যন্ত ত্রিপুরায় যতগুলি নির্বাচন হয়েছে, তাতে মূল প্রতিপক্ষ ছিল কংগ্রেস ও সিপিএম (বামফ্রন্ট)-মূলত এই দুইটি প্রধান শক্তি একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। এবারই প্রথম দুই চিরশত্রু এক হয়ে লড়াই করেছে বিজেপিকে উভয়ের প্রধান প্রতিপক্ষ চিহ্নিত করে।
এবার আসা যাক মূল বিষয়ে। মাঝে পাঁচ বছর বাদ দিলে দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা বামফ্রন্ট সরকারকে ২০১৮ সালে ক্ষমতাচ্যুত করে বিজেপি-আইপিএফটি জোট। ২০১৮ সালের নির্বাচনে মোট ভোটের ৪৩.৫৯ শতাংশ ভোট পেয়েছিলো বিজেপি। সিপিআই(এম) অর্থাৎ বামফ্রন্ট পেয়েছিলো ৪২.২২ শতাংশ ভোট। বিজেপির শরিক দল আইপিএফটি পেয়েছিলো ৭.৩৮ শতাংশ ভোট আর কংগ্রেস দল পেয়েছিলো ১.৭৯ শতাংশ এবং তৃণমূল কংগ্রেস দল পেয়েছিলো মাত্র ০.৩ শতাংশ ভোট। প্রাপ্ত ভোটের নিরিখে বিজেপি পায় ৩৬টি আসন, আইপিএফটি ৮টি এবং বামেরা পায় ১৬টি আসন। এক বছরের মাথায় ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বিজেপি তাদের প্রাপ্ত ভোটের হার অনেকটাই বাড়িয়ে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, ২০১৮ বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস দলের যে শোচনীয় (১.৭৯%) ফলাফল হয়েছিলো, ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস অনেকটাই তাদের শক্তি পুনরুদ্ধার করে নিতে পেরেছিলো। কিন্তু ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে বামেদের ভোট কংগ্রেস থেকেও নিচে নেমে যায়। লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি একাই পেয়েছিলো ৪৯.০৩ শতাংশ ভোট। কংগ্রেস পেয়েছিলো 25.34 শতাংশ ভোট এবং সিপিএম পেয়েছিলো ১৭.৩১ শতাংশ ভোট। বামেদের এই রক্তক্ষরণ এক বছর আগে অনুষ্ঠিত ত্রিপুরা স্বশাসিত জেলা পরিষদের নির্বাচনেও অব্যাহত থাকে। এডিসি নির্বাচনে বামেদের ভোট আরও নিচে চলে যায়। এডিসি নির্বাচনে বামেরা পায়। ১২.৪৬ শতাংশ ভোট। পাহাড়ে নতুন শক্তি হিসেবে উঠে আসে তিপ্ৰা মথা। এডিসি ভোটের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় বামেদের একটা বড় অংশের ভোট, আইপিএফটির পুরো ভোট তিপ্ৰা মথায় চলে গেছে। বিজেপি থেকেও তিপ্ৰা মথায় কিছু ভোট গেছে। তবে সেটা খুব একটা বেশি নয়। এডিসি নির্বাচনে আইএনপিটি মিশে যায় তিপ্ৰা মথায়। ফলে সিপিএম, আইএনপিটি, আইপিএফটি – এই সব ভোট মথায় গেছে। তাতে যুক্ত হয়েছে বিজেপির এক থেকে দুই শতাংশ ভোট। ফলাফল সকলের সামনে। এডিসিতে বাম এবং আইপিএফটি শূন্য হয়ে যায়।
এরপর গত এক বছর ধরে হাওড়া, গোমতী দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। রাজ্য রাজনীতির গতিপ্রকৃতিতে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে। যারা এক সময় পদ্ম হাওয়ায় নিজেদের শামিল করে কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলো, তাদের মধ্যে সবাই না হলেও তিনজন ফের কংগ্রেসে ফিরে এসেছেন। একজন ২০২০ ভোটের প্রাক্কালে কংগ্রেসে এসেছেন। কেননা, বিজেপিতে থাকলে তিনি এবার টিকিট পাবেন না এটা এক প্রকার নিশ্চিতই ছিলো। ফলে শেষ মুহূর্তে কংগ্রেসে এসে কংগ্রেসের টিকিটে লড়েছেন। এবার আসা যাক মূল বিষয়ে। ২০১৮ সাল থেকে সর্বশেষ পুর ও নগর নির্বাচন পর্যন্ত ভোটের যে পরিসংখ্যান বেরিয়ে এসেছে, তাতে বামেদের যে শক্তিক্ষয় হতে দেখা গেছে, তা কি গত ছয়-সাত মাসে পুনরুদ্ধার করতে পেরেছে? এই প্রশ্নের জবাবের সাথে এবার ২০২৩-এর নির্বাচনে আরও বেশ কিছু বিষয় এবং প্রশ্ন রয়েছে। সেই সব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হবে। জবাব পেয়ে গেলে ভোটের ফলাফল কী হতে পারে তার একটা অনুমান অবশ্যই করা যাবে। প্রথমত, চিরশত্রু দুই দলের (সিপিএম-কংগ্রেস) জোটকে গণদেবতারা মন থেকে মেনে নিয়েছে কিনা? দ্বিতীয়ত, কংগ্রেসের ভোট সিপিএমে গেছে কিনা? পশ্চিমবঙ্গে ২০১৬ এবং ২০২১ পর পর দুইটি বিধানসভা নির্বাচনে বাম-কংগ্রেস জোট করে লড়াই করেছে। ফলাফলে দেখা গেছে, পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের ভোট সিপিএমের বাক্সে যায়নি। তবে ত্রিপুরাতেও এমন হবে তা ভাবার কারণ নেই। বঙ্গের মতো এখানে এমন নাও হতে পারে। তাছাড়া লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে বিচার করলে ২০২৩ বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ১৩টি আসনে লড়াই করার যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। কারণ সিপিএম থেকে কংগ্রেসের ভোট বেশি ছিলো। তৃতীয়ত, গ্রেটার তিপ্রাল্যাণ্ডের আবেগপূর্ণ স্লোগানে বামেদের জনজাতি ভোট ব্যাঙ্কে যে ধস নেমেছিলো, এক বছরের মধ্যে তা কতটা পুনরুদ্ধার করা গেছে? আদৌ গেছে কি? চতুর্থত, ২০টি জনজাতি আসন ছাড়াও আরও ২২টি সাধারণ ও তপশিলি আসনে তিপ্রা মথার প্রার্থী দেওয়া কীসের ইঙ্গিত? এতে কাদের সুবিধা হলো আর কাদের সমস্যা হলো? পঞ্চমত, এবার বিধানসভা নির্বাচনে পুরুষদের চাইতে মহিলারা তিন শতাংশ বেশি ভোট দিয়েছে। এই তিন শতাংশ ভোট কোন্ দিকে গেল? এছাড়াও রয়েছে আরও একাধিক বিষয়। মূলত এই পাঁচ-ছয়টি প্রশ্নের জবাব মিলে গেলে প্রত্যাবর্তন না পরিবর্তন তার একটা অনুমান করা যেতে পারে। তবে আসল জবাব পাওয়া যাবে ২ মার্চ। তার জন্য অপেক্ষা করতেই হবে।

Dainik Digital

Recent Posts

এ কে-৪৭ ও প্রচুর কার্তুজ সহ ৬ বৈরী ধৃত মিজোরামে, চাঞ্চল্য!!

অনলাইন প্রতিনিধি:- বাংলাদেশ থেকে কাঞ্চনপুর মহকুমার ভারত- বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে মিজোরামে যাওয়ার পথে মামিত জেলার…

15 hours ago

ফাইফরমাশ খাটছেন টিএসআর জওয়ানরা !!

অনলাইন প্রতিনিধি :- নিরাপত্তার কাজে নয়, টিএসআর জওয়ানদের খাটানো হচ্ছে আর্দালি হিসাবে। পুলিশ আধিকারিকদের ও…

15 hours ago

ইন্ডিগো আরও একটি দিল্লীর বিমান চালু করছে!!

অনলাইন প্রতিনিধি :- ইন্ডিগো আগরতলা- দিল্লী রুটের উভয় দিকে যাতায়াতে আরও একটি বিমান চালু করছে।…

16 hours ago

ইন্দ্রপ্রস্থে ভোট!!

দিল্লীর বিধানসভা ভোট নিয়ে সরগরম দিল্লী। দিল্লীতে এবার এক আঙ্গিকে বিধানসভা ভোট হচ্ছে। গত পরিস্থিতির…

16 hours ago

বহিঃরাজ্যে গেল “ধানি লঙ্কা”ওরফে ধান্না মরিচ!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-ত্রিপুরায় উৎপাদিত" অর্গানিক বার্ড আই চিলি " স্হানীয় ভাষায় যাকে বলা হয় ধানি…

2 days ago

কুম্ভ ইকনমি

২২জানুয়ারী,২০২৪।এক বছরের ব্যবুধানে ২০২৫ সালের ১৩ জানুয়ারি।গত বছরের মেগা ইভেন্টের আসর বসেছিল অযোধ্যায়। এবার মেগা…

2 days ago