রাজ্য মধ্যশিক্ষা পর্ষদের পরীক্ষা ফেব্রুয়ারী মাসে করার উদ্যোগ!!
প্রবীণ কেন নিঃসঙ্গ!
শ্রেষ্ঠতর প্রাণী হিসাবে দাবি করা ‘মানুষের’ প্রবীণদের প্রতি সংবেদনা (সমবেদনা নয়) যে কত অকিঞ্চিৎকর, দীপাবলির রাতে শব্দবাজির তাণ্ডব তারই এক খণ্ডচিত্র। ক্যান্সার অথবা হৃদরোগে শয্যাশায়ী প্রতিবেশীর জানলার পাশেই শব্দবাজির তাণ্ডব দেখেও নীরব থাকা আর যা-ই হোক,সুনাগরিকের লক্ষণ হতে পারে না। বয়স্ক মানুষ যাদের স্নায়ু ও হৃদযন্ত্র দুর্বল, তাদের অনেকের পক্ষেই দীপাবলির উৎসব যে কার্যত প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে, এবারও আমরা তার ব্যতিক্রম দেখিনি। আইন করে এর সুরাহা হওয়া মুশকিল আমার আনন্দ যে অপরের যন্ত্রণার কারণ হচ্ছে, এমনকি শেষ পর্যত তা আমারও ক্ষতি করতে পারে, কর্মক্ষম মনুষ্য প্রজাতি দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা বিস্মৃত হয়েছে। মূল স্রোতের সমাজের সঙ্গে প্রবীণরা কীভাবে জড়িয়ে আছেন, সেই সত্য উদ্যাপনের লক্ষ্যে ১৯৯০ সাল থেকে রাষ্ট্রপুঞ্জ পয়লা অক্টোবর দিনটি সারা বিশ্বে ‘আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস’ হিসাবে পালন করে চলেছে। কিন্তু বিশ্বজোড়া প্রবীণ’ও বৃদ্ধ মানুষেরা কি এই একটি দিনে সব অপমান অবহেলা ভুলে হঠাৎ আহ্লাদিত হয়ে উঠতে পারেন? হয়তো সমাজে প্রবীণদের ভূমিকা নিয়ে এই বিশেষ দিন নির্ধারণের পিছনে কাজ করেছে বিশ্বে জনবিস্ফোরণের বাস্তবতা। মৃত্যুর হার কমছে, বেড়ে চলেছে বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা। ২০২২-এ বিশ্বের জনসংখ্যার দশ শতাংশ ছিলেন পঁয়ষট্টির বেশি বয়সি। ২০৫০ সালে তা হবে বোল শতাংশ, ২১০০ সালে তা গিয়ে দাঁড়াবে তেইশ শতাংশে। পশ্চিম এশিয়া, আফ্রিকার কম উন্নত দেশে প্রবীণদের অংশ অবশ্য জনতার মাত্র দুই শতাংশ। কিন্তু ইউরোপীয় দেশগুলিতে, উত্তর আমেরিকায়, এশিয়ার নানা দেশে প্রতি চারজন নাগরিকের একজন প্রবীণ। শারীরিকভাবে ক্রমশ অশক্ত হওয়া এই মানুষদের ভালো থাকার জন্য এ দেশে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই, এ আসলে অর্ধসত্য। আদপে এদের ভালো রাখার দর্শনটাই এ দেশ শিখে উঠতে পারেনি। এ কথা হয়তো ঠিক, এই প্রবীণরাও অনেকে যৌবনে তাদের পরিপার্শ্বকে হয়তো ভালো রাখেননি। এদের উত্তর প্রজন্মও কর্মব্যস্ত জীবনে ও অন্য নানা কারণে এদের যত্ন নিতে অপারগ। এই যুক্তিতে কিন্তু রাষ্ট্র প্রবীণদের ছড়ে ফেলে দিতে পারে না। উচ্চবিত্ত গৃহে পরিচালক- নির্ভর প্রবীণ কিংবা মধ্যবিত্ত গৃহে একলা হয়ে যাওয়া প্রবীণ, দরিদ্র ভিটেয় অসুস্থ প্রবীণ আর খোলা আকাশের নিচে পরিত্যক্ত প্রবীণ এ সমাজের এক প্রকটতম সত্য। তাদের সাহচর্য দেওয়ার লোক কম বা নেই, পরিবারে তাদের জন্য ব্যয়-বরাদ্দ ক্রমহ্রাসমান। স্বাস্থ্য-চিকিৎসা অনেক পরের কথা, বহু প্রবীণ ঘরের আশ্রয় থেকেই বঞ্চিত। বৃদ্ধাদের অবস্থা আরও দুঃসহ। বৃদ্ধারা শুধু অবহেলিত বা অপমানিত তাই নয়, ঘরে তারা শারীরিক নির্যাতনেরও শিকার হন! অথচ পরনির্ভরশীল জীবন তারা হাসিমুখে যাপন করতে পারেন শুধু তাদের প্রতি একটু মানবিক আচরণ করা হলে, সামান্য একটু কর্তব্য পালন করা হলে। মূল্যবোধের অবক্ষয় মানুষকে কোনও অতলে নামিয়ে দিচ্ছে। বিবেকহীন, মনুষ্যত্বহীন, কর্তব্যজ্ঞানহীন ভোগবাদী মানুষের বিবেক জাগাতে প্রয়োজন কঠোর অনুশাসন ও আইন। সর্বোপরি, বৃদ্ধাদের অধিকাংশ ক্ষেত্রে লড়াই করার প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থাকে না (বৃদ্ধদের সাপেক্ষে বৃদ্ধাদের সাক্ষরতা অর্ধেকেরও কম)। তাদেরই বাড়িতে তারা কোণঠাসা হয়ে যান, তাদেরই সঞ্চিত অর্থ তাদের জন্য ব্যয় হলে তা অপব্যয়’ সাব্যস্ত হয়। ‘পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স’ সমীক্ষা প্রমাণ, এদেশে পুরুষের তুলনায় দ্বিগুণ সংখ্যায় নারীর বার্ধক্য কাটে পরের আশ্রয়ে। একা বাঁচাও যে মানুষের অধিকার, তা বোঝার মতো রোধে এখনও পৌঁছতে পারেনি দেশ। অথচ ধীরে হলেও এদেশে একা-বাঁচতে চাওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। সচেতন মানুষ হিসাবে এ ব্যর্থতা আমাদেরই, যারা এই গতিশীল যুগে দাঁড়িয়ে প্রবীণ-প্রবীণাদের ‘সময়ের অপচয়’-এ পরিণত করেছি। অথচ একই সংসারে থেকে যখন প্রবীণ-প্রবীণারা অবহেলিত হচ্ছেন আর শিশুরা বাড়তি যত্ন পাচ্ছে, তখন শিশু মনেও এর প্রভাব পড়ে। ট্রেনে প্রবীণদের ভাড়া ছাড়ের ন্যূনতম সুযোগটাও কেড়ে নেওয়া হয়েছে কেভিড-অতিমারির অজুহাতে। আজ অবধি তা আর ফিরিয়ে আনা হয়নি। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, রেলমন্ত্রী সকলেই প্রবীণ। কিন্তু প্রবীণ নাগরিকদের কল্যাণ চিন্তার ক্ষেত্রে তারা সকলেই উদাসীন। তবে কী, কর্তব্য যারা ভুলে যায়, ভাদের বিবেককে চাবুক মেরে জাগানো প্রয়োজন।