প্রশস্ত হচ্ছে ফাটল

 প্রশস্ত হচ্ছে ফাটল
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

হঠাৎ করেই যখন কোথাও বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠে, এবং দপ্ করেই আচমকা সেই আগুন যখন নিভে যায়,তখন বুঝতে হবে এই আকস্মিক সবকিছু স্বাভাবিক চুপচাপ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা মোটেই ভালো লক্ষণ নয়। এই স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ার পেছনে হয়তো আগামীতে কোনও বড় ঝড় কিংবা বিপর্যয়ের বীজ সন্তর্পণে বুনে নেওয়ার প্রস্তুতি শুরুর ছক থাকতে পারে।সম্প্রতি রাশিয়াতে প্রেসিডেন্ট পুতিনের বিরুদ্ধে ওয়াগনার গ্রুপের ভাড়াটে সেনাদের জেহাদ এবং মুহূর্তেই তা সমঝোতা করে নেওয়ার প্রয়াসের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যৎ বিপদের গন্ধ কিন্তু আঁচ পাওয়া যাচ্ছে।পুতিনের বিরুদ্ধে প্রায় ২৪ ঘন্টা স্থায়ী এই বিদ্রোহ সামাল দিতে রুশ প্রেসিডেন্টকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হলেও এই অল্প সময়ের মধ্যেই পুতিনকে যে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে,এরকম পরিস্থিতি রাশিয়ায় শাসন ক্ষমতায় আসীন পুতিনের ২০ বছরের সময়কালে কখনও দেখা যায়নি। হয়তো দ্রুত পরিস্থিতি সামাল দিয়ে ক্রেমলিন ওয়াগনার বাহিনীর সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য হয়েছে।শুধু চুক্তি স্বাক্ষরই নয়, পুতিনের হুঙ্কার অনুযায়ী ‘বিশ্বাসঘাতক’ ওয়াগনার গ্রুপের উপর থেকে সমস্ত মামলা ও অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিতে হয়েছে ক্রেমলিনকে। কিংবা সবাইকে চমকে দিয়ে বিদ্রোহী নেতা প্রিগোঝিন যখন ঘোষণা করলেন ‘রুশ রক্তপাত রুখতে’ তারা পিছু হটছেন, তখন সার্বিক পরিস্থিতি থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে, আপাতত উত্তেজনা প্রশমন হয়ে গেলেও মস্কোর আকাশ থেকে ভবিষ্যতে আশঙ্কার কালো মেঘ কিন্তু কাটছে না। বিশেষ করে তার প্রবল প্রতিপক্ষ ওয়াগনার নেতা প্রিগোঝিনের বিরুদ্ধে ঘৃণা এবং পেছন থেকে ছুরি মারার অভিযোগ তুললেও গোটা পদক্ষেপের মধ্যে পুতিনকে কিন্তু খুব শক্তিশালী অবস্থানে দেখা যাচ্ছে না। বরং পুতিনকে বড় বেশি করে বিধ্বস্তই মনে হচ্ছে। কারণটা খুব পরিষ্কার। বিদ্রোহের পেছনে প্রধান যিনি ব্যক্তি, ইয়েভগেনি প্রিগোঝিন তিনি একজন স্বাধীন মানুষ।তিনি প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে রাশিয়ার সামরিক নেতৃত্বকে উৎখাতের চেষ্টা করলেও তার বিরুদ্ধে পুতিন বিদ্রোহের সব অভিযোগ তুলে নিয়েছেন। এই ভাড়াটে গ্রুপের নেতা দীর্ঘসময় ধরে রাশিয়াতে পর্দার আড়ালে কাজ করে চলেছেন। এমনকী বর্তমানে চলা গুরুত্বপূর্ণ ইউক্রেন যুদ্ধের তিনি এক নির্ণায়ক শক্তি। ফলে নিশ্চিতভাবেই পুতিনের ভবিষ্যতের প্রশ্নেও তার ভূমিকা অস্বীকার করার জো নেই। কারণ ক্রেমলিনের জন্য বছরের পর বছর ধরে বহু বিতর্কিত কাজ তিনি করে গেছেন। সিরিয়া থেকে শুরু করে সর্বশেষ ইউক্রেন সংঘাত – সবক্ষেত্রেই ওয়াগনার গ্রুপের অংশগ্রহণ ছিল গুরুত্বপূর্ণ। একসময়ের পুতিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সাম্প্রতিক সময়ে বড় প্রতিপক্ষ প্রিগোঝিনের এই বিদ্রোহ যে পুতিনের দুর্বলতাকে অনেকটাই প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রাশিয়া মুখে স্বীকার না করলেও এই বিদ্রোহ ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে নতুন কোনও মোড় নিতে পারে সেই আশঙ্কাও কিন্তু থেকে যাচ্ছে। বেলারুশের মধ্যস্থতায় আপাতত রাশিয়ার আকাশ থেকে সংকট কেটে গেলেও রাশিয়ার সর্বক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট পুতিনকে হঠাৎ করেই এই বিদ্রোহের পর নড়বড়ে আর দুর্বল শাসক হিসাবেই চোখে পড়ছে। বিশেষ করে পুতিন যেভাবে বিদ্রোহীদের সঙ্গে সমঝোতা করতে বাধ্য হয়েছেন,সেটা পুতিনের জন্য নি:সন্দেহে এক ধরনের অপমানজনক পরাজয়।কেন পুতিনকে এ ধরনের সমঝোতায় যেতে হল, ওয়াগনার গ্রুপের এই বিদ্রোহের পর রাশিয়ায় তার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব পুতিন কতদিন টিকিয়ে রাখতে পারবেন এই প্রশ্নগুলোই এখন ঘুরেফিরে আসছে। তবে এটা ঘটনা, ক্রেমলিনকে সামনের দিনগুলোতে খুবই অস্থির একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। হয়তো বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছে এবং ওয়াগনার গ্রুপের সাথে একটা আপাত সমঝোতার মাধ্যমে এ যাত্রায় সংকট এড়ানো গেছে।কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি থেকে এটা স্পষ্ট যে, ভাড়াটে সেনাদের বিদ্রোহ পুতিনের ক্ষমতা এবং ইউক্রেনের যুদ্ধে পুতিনের অবস্থানকে বড়সড় ধাক্কা দিয়েছে। এই গৃহযুদ্ধ রাশিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর দুর্বলতাকেও স্পষ্ট করে দিয়েছে।কেননা, নিজের দেশের ভেতরেরই হুমকি মোকাবিলা করতে নিজ দেশের নিরাপত্তা বাহিনীকে সময়মতো কাজে লাগাতে একজন শাসক কতটা ব্যর্থ হতে পারেন তা পুতিন নিজেই নিজেকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। এর অর্থই হলো দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর উপর পুতিনের সর্বময় কর্তৃত্ব হয় শিথিল হয়ে পড়েছে বা ক্ষয়ে গেছে কিংবা মাঝখানে কোথাও বিশাল চিড় ধরেছে।কেননা, একদল সশস্ত্র লোক যখন কোনও বাধা বা প্রতিরোধ ছাড়াই শত শত কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে খোদ রাজধানীর কাছাকাছি চলে আসতে পারে— এটা যে পুতিনের সামরিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কত বড় ঘাটতি তা বলার আর অবকাশ থাকে না। একনায়ক শাসক যখন এভাবেই দুর্বল হয়ে পড়েন, তখন তার কাছে একটাই পথ খোলা থাকে। সেটা হলো আরও বেশি নিষ্ঠুর হওয়া। আরও বেশি শক্তি প্রয়োগ করা, দেশের মানুষের মতপ্রকাশের বাকি অধিকারও কেড়ে নেওয়া এবং গণমাধ্যমের টুটিকে চেপে ধরা। কিন্তু এটা করতে গিয়ে ফাটল আরও উন্মুক্ত হবে। আসলে এটা রাষ্ট্রক্ষমতার সংকট না হলেও ব্যক্তি পুতিনের সংকট থেকে রাশিয়ার বড়সড় বিপর্যয়ের পথ উন্মোচিত করতে পারে। আপাতত এটাই রাশিয়ার জন্য বিপদের ইঙ্গিত।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.