দ্বিতীয়দিন ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হলো হাজারো দর্শক-শ্রোতা!!
প্রশ্নের মুখে বিশ্বস্ততা

নির্বাচনের আগেই উপরাষ্ট্রপতি পদে এনডিএ জোটের প্রার্থী জগদীপ ধনখড়ের জয় এক প্রকার নিশ্চিত হয়ে গেছে । যদিও সংসদের দুই কক্ষ লোকসভা ও রাজ্যসভার সদস্যদের মিলিত ভোটের নিরিখে এনডিএ জোটের প্রার্থীর জয় পাকাই ছিলো । কিন্তু ভোটপর্ব শুরু হওয়ার আগেই যে অজুহাত দেখিয়ে উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তৃণমূল ভোট না দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেছে সেটা যে কার্যত খেলার আগেই প্রতিপক্ষ দলকে অনেকটা অ্যাডভান্টেজ পাইয়ে দেওয়ার মতোই ঘটনা , সেটা রাজনীতির অ আ ক খ জানা লোকের কাছেও পরিষ্কার ।

যদিও ধনখড়ের বিপরীত পক্ষে ছঁড়ানো বিরোধীদের উপরাষ্ট্রপতি পদের প্রার্থী মার্গারেট আলভা শুক্রবার একটি তাৎপর্যপূর্ণ ট্যুইট করেছেন , যাতে তিনি লিখেছেন , ভোট প্রক্রিয়ায় তৃণমূলের অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত খুবই হতাশাজনক । এই মুহূর্তে ইগো বা অভিমান দেখানোর সময় নয় । এখন সাহস দেখানো , নেতৃত্বে দেওয়ার এবং ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সময় ।তৃণমূলের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই মার্গারেট আলভার নাম ঘোষণা করা হয়েছে- এই অজুহাত দেখিয়ে মমতা ব্যানার্জি উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দলের সদস্যরা ভোটদানে বিরত থাকবেন বলে জানিয়েছেন

বরাবরই বিরোধীদের মাঝখানে প্রতিবাদী মুখ হিসাবে সুপরিচিত মমতার এই আকস্মিক সিদ্ধান্ত যে হটকারী এবং প্রকারান্তরে শাসক বিজেপির জয়ের রাস্তাটা একশ ভাগ নিশ্চিত করারই কৌশল সেকথা বোঝার জন্য রাজনীতির বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই । যদিও শারদ পাওয়ারের বাড়িতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে মার্গারেট আলভার নামটি সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন করা হয় । শারদ পাওয়ারের অনুযায়ী এই নামের জন্য তৃণমূলের কাছ থেকেও ফোনে অনুমতি চাওয়া হয়েছিল । তর্কের খাতিরে যদি বলা হয় উপরাষ্ট্রপতির নাম ঠিক করার সময় মমতার সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি , তাহলে নিঃসন্দেহে এটা অবাঞ্ছিত ও অন্যায় হয়েছে।

কিন্তু পাশাপাশি এ কথাটাও বলতে হবে , মমতার ভোট না দেওয়ার সিদ্ধান্তটিও কোনও ভাবেই উর্বর রাজনীতির মস্তিকের পরিণাম নয় একই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নও এখানে এসে যায় , রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী ঠিক বক্তব্য করতে দিল্লীর কনস্টিটিউশন ক্লাবে যখন মমতা বৈঠক ডেকেছিলেন তখন আগাম কোন্ কোন্ বিরোধী দলের সঙ্গে তিনি কথা বলেছিলেন ? উত্তর হচ্ছে , কারোর সঙ্গেই নয় । বরং দ্রৌপদী মুর্মুর নাম যখন এনডিএ শিবির রাষ্ট্রপতি পদের প্রার্থী হিসাবে ঘোষণা দেয় তখন মমতা কেন আগ বাড়িয়ে ইস্কনের রথের মেলায় সাংবাদিকদের কাছে বলতে যান , যশোবন্ত আমাদের পছন্দ করা প্রার্থী নয় , কিন্তু তিনি যেহেতু মনোনয়ন জমা দিয়ে দিয়েছেন তাই এখন কিছু করার নেই ।

আসলে দ্রৌপদীর নাম এনডির প্রার্থী হিসাবে ঘোষণা হতেই মমতার আদিবাসী ভোটের চিন্তাটা মাথায় আসে । কারণ নিজ রাজ্যের একটা বড় অংশই আদিবাসী অধ্যুষিত , যেখানে নিজ দলের বিধায়করা প্রতিনিধিত্ব করছেন । তাই নরমেগরমে দ্রৌপদী মুর্মু ইস্যুতে নিজের ভোট ব্যাঙ্ক অটুট রাখাটা বেশি জরুরি ছিল । অপরদিকে উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে এনডিএন প্রার্থী ধনখড় , যিনি বিগত তিনটি বছর প্রায় প্রতিদিনই তৃণমূলের গলার কাঁটা হয়ে বিঁধছিলেন তাকে এনডিএ প্রার্থী করার পেছনে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই দার্জিলিংয়ে মমতা- হিমন্ত – ধনখড় বৈঠকের ছায়া দেখছেন ।

এই অবস্থায় সাংসদদের নামমাত্র ভোটে এনডিএ এগিয়ে থাকলেও জয় নিশ্চিত করার যে স্বস্তি সেটা তৃণমূলের চেয়ে নির্ভরযোগ্য আর কোনও বিকল্প বিজেপির সামনে ছিলো না । এর উপর কয়লা কাণ্ড , গরু পাচার কাণ্ড , সারদা – নারদা , টেট , এসএসসির ভূত সর্বক্ষণই তাড়া করে বেড়াচ্ছিল তৃণমূলকে । ছিল সিবিআই – ইডির সর্বক্ষণের আতঙ্ক । এই সবকিছুর মিলিত ফল হিসাবেই যে উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মমতার আচমকা ইউ – টার্নের ঘটনা ঘটে যায় সেটাই বলাই বাহুল্য । কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অনেকেই মনে করেন , তৃণমূল আদৌ কখনোই মোদিবিরোধী ছিল না ।

এতদিন সাধারণ মানুষ যেটা প্রত্যক্ষ করেছেন সেটা স্রেফ রাজনীতির প্রয়োজনে কানামাছি খেলা । সেদিক থেকে উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোটদানে বিরত থাকার মমতার সিদ্ধান্তে আখেরে বিজেপির লাভ হলেও মমতা কিন্তু নিজের তৈরি করা চক্রব্যূহের মধ্যেই ক্রমে জড়িয়ে যেতে চলেছেন । আপাতত বিরোধী ঐক্য বা বিরোধী জোট মমতার সিদ্ধান্তে বড়সড় ধাক্কা খেলেও মমতার ব্যক্তিইমেজ , তার রাজনৈতিক নীতিবোধ ও আদর্শ কিন্তু প্রশ্নের মুখে এসে পড়লো ।

আর সত্যিকার অর্থেই বিজেপির মতো সর্বগ্রাসী দল রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনের তরী পার হবার পর দুর্নীতি ও অপশাসনে জজরিত যে দুর্বল স্থানটিতে হামলে পড়বে সেটা সন্দেহাতীত ভাবেই পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের রাজ্যপাট । আর তখন বিরোধী শিবিরেও তৃণমূলের প্রাসঙ্গিকতা আর থাকবে না । যার ফলে রাজনীতির আত্মঘাতী চালেই মমতা যে আগামীতে কঠিন সঙ্কটে পড়তে চলেছেন এর বেসুরো বাতাস কিন্তু ইতিমধ্যেই বইতে শুরু করেছে ।