প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের এক সেতু- স্বামীজী

 প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের এক সেতু- স্বামীজী
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

স্বামীজী এমন এক সময়ে জন্মগ্রহণ করেন , যখন ভারতমাতা পরাধীনতার নাগপাশে আবদ্ধ । তিনি দেখেছিলেন— ভারতের সমস্ত দুঃখ দুর্দশার মূল- জন সাধারণের দারিদ্র ।…………. পুরোহিত শক্তি ও পরাধীনতা – তাদের শত শত শতাব্দী ধরে নিষ্পেষিত করেছে , অবশেষে দরিদ্র জনগণ ভুলে গেছে যে , তারাও মানুষ । স্বামীজী প্রতিভাবান মানুষ । তিনি উপনিষদ্ ও বেদান্তের নির্যাসটুকু গ্রহণ করেছেন এবং ব্যাখ্যা করেছেন আধুনিক বৈজ্ঞানিক ভাষায় । ভারতের জনসাধারণের শিক্ষার অভাব , কুসংস্কার , দারিদ্র , জাতিভেদ প্রথা , নারী শিক্ষার অভাব প্রভৃতি বিষয়ে স্বামীজী অবগত ছিলেন । দেহত্যাগের ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের পর স্বামী বিবেকানন্দ সমগ্র ভারত ভ্রমণ করেন ও ভারত সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ করেন । তিনি ভারতবর্ষের অতি নি : স্ব দরিদ্র থেকে রাজা মহারাজাগণের দৈনন্দিন জীবনযাপন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন । এই সময় তিনি শিকাগো ধর্মসভায় যোগ দিয়ে হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করার সিদ্ধান্ত নেন । প্রাচ্য- পাশ্চাত্যের সেতু বন্ধনের এক চমৎকার সুযোগ দেখা দেয় , স্বামীজীর জীবনে । আমাদের মনে অবশ্যই এই প্রশ্ন জাগে , আমেরিকায় বিবেকানন্দের পদার্পণের আগে সেখানকার সামাজিক প্রেক্ষাপট কেমন ছিল । বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় , সেখানে প্রাচ্যের দর্শন আগে এসে পৌঁছেছিল । এমারসন , থোরো , চানিং প্রমুখ ব্যক্তিত্ব এই নতুন মহাদেশে আধ্যাত্মিক ভারতের সংবাদ আগেই ছড়িয়ে দেন । ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে ‘ আমেরিকান প্রাচ্য সোসাইটি ’ প্রতিষ্ঠিত হয় । কোন কোন দার্শনিক ( যেমন , এমারসন , থোরো ) স্বপ্ন দেখতেন যে প্রাচ্য পাশ্চাত্যের মিলনে এক নতুন প্রাচ্য সংস্কৃতির জন্ম হবে । কিন্তু নানা কারণে তা সম্ভব হয়নি । ভারতে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজদের শাসন চলছিল । আমেরিকায় ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে আব্রাহাম লিংকনের শাসন সেখানে শুরু হয়েছিল গৃহযুদ্ধ । তাহলে পশ্চিমে বেদান্ত ভাবনা কীভাবে প্রবেশ করল- এ প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক । জানা যায় , সম্রাট শাহজাহানের পুত্র দারা শুকো পঞ্চাশটি ( ৫০ টি ) উপনিষদ সংস্কৃত থেকে পার্শি ভাষায় অনুবাদ করান । এক ফরাসি পণ্ডিত ১৮০১-১৮০২ খ্রিস্টাব্দে এই উপনিষদসমূহকে ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করেন । শোপেন হাওয়ার নামে প্রখ্যাত জার্মান পণ্ডিত এই উপনিষদসমূহ পাঠ করেছিলেন । ম্যাক্সমুলার ও পল ডয়সন ইউরোপে এই প্রাচ্য ভাবনার প্রচার করেন । চার্লস ইউলকিস ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে গীতার অনুবাদ করেন । এই অনুদিত গীতার ভিত্তিতে এমারসন ‘ দ্য ব্রহ্ম ‘ নামে একটি কবিতা এবং অন্য একটি প্রবন্ধ লেখেন । এই সময় অনুপ্রাণিত এমারসনকৃত রচনায় হয়ে ( Edwin Arnold ) এড্‌উইন আরনও রচনা করেছিলেন ‘ লাইট অব এশিয়া ’ ( Light of Asia ) নামক গ্রন্থটি । সুতরাং বলা যেতে পারে স্বামীজী আমেরিকায় যাওয়ার আগেই সেখানে প্রাচ্য চিন্তাভাবনা পৌঁছেছিল । স্বামী বিবেকানন্দ বুঝেছিলেন , বেদান্ত সম্পর্কে কিছু বললে তা আমেরিকান জনগণ সহজেই হৃদয়ঙ্গম করতে পারবেন । এর কারণ , আমেরিকার মানুষ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ও তারা স্বাধীনতাপ্রিয় । তারা একনায়কতন্ত্র পছন্দ করে না তেমনি বেদান্তের ধারণা এক গণতান্ত্রিক ধারণা । সকলকে ধন্যবাদ জানাই। প্রসঙ্গক্রমে স্বামীজীর ধর্ম সম্পর্কিত বক্তৃতার দুই একটি কথা বলতে হয় । স্বামীজী বলেছিলেন । সর্বধর্মের প্রসূতি স্ব বদ পা হিন্দুধর্মের প্রতিনিধি হিসাবে সারা বিশ্বের সমস্ত হিন্দু – নরনারীর পক্ষ থেকে আমি সকলকে ধন্যবাদ জানাই। ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে তিনি বলেছিলেন, আমি সেই ধর্মভুক্ত বলে গর্ববোধ করি যে ধর্ম জগতকে চিরকাল সমদর্শন ও সর্ববিধ মত গ্রহনের বিষয় শিক্ষা দিয়ে আসছে। আমরা সব ধর্মকেই সত্য বলে বিশ্বাস করি। এ সময় ইহুদিরা পৃথিবীর অন্য কোথাও আশ্রয় না পেয়ে ভারতে এসেছে এবং সাদরে গৃহীত হয়েছে । স্বামীজীর আত্মগৌরব সম্পর্ক বক্তব্য শুনে ভারত সম্পর্কে পাশ্চাত্যবাসীর পাহাড় প্রমাণ অজ্ঞতা দূর হয়েছে । সম্ভবত : ভারতবাসী এই প্রথম জানল , নিজের ধর্ম নিয়ে গর্ব করা যায় । ইউরোপের সর্বত্র মানুষের অনন্ত শক্তি , সম্ভাবনা ও দেবত্বের কথা স্বামীজী দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন । স্বামীজী দেখেছিলেন , ভারতবর্ষ বহুদিন বাইরের জগত থেকে নিজেকে সংকুচিত করে রেখেছিল ….. অন্যজাতির সঙ্গে নিজেদের তুলনা করে দেখেনি । কিন্তু আদান প্রদানই প্রকৃতির নিয়ম । তাই পৃথিবীর সব জাতির সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে । কারণ সম্প্রসারণই জীবন— সংকীর্ণতাই মৃত্যু। আমাদের আধ্যাত্মিক রাজ্যের অপূর্ব তত্ত্বগুলির বিনিময়ে পাশ্চাত্যের কাছ থেকে জড় জগতের অর্থাৎ আধুনিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলি আমাদের জানতে হবে । স্বামীজী প্রথমবার ও দ্বিতীয়বার মিলে মোট পাঁচ বছর পাশ্চাত্যে ছিলেন । আমেরিকা সেসময় গণতান্ত্রিক দেশ , মার্কিন নাগরিকরা ছিল মুক্তমনা । কিন্তু ভারতে সে সময় ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ । ভারতে শিক্ষার হার ছিল দশ শতাংশের মতো । কিন্তু আমেরিকায় তখন শিক্ষার হার প্রায় একশ ভাগ ( ১০০ শতাংশ ) তখন ভারতের নব্বই শতাংশ মানুষের দু – বেলা অন্ন জুটতো না কিন্তু আমেরিকান জনগণ ছিল সমৃদ্ধিশালী ও ধনী । অন্যদিকে জাতিভেদ পুরোহিততন্ত্র ও জমিদারদের অত্যাচার হিন্দু জনগণ পদদলিত । ভারতীয় নারীরা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত – কিন্তু মার্কিন ভারতে প্রথা , মহিলারা শিক্ষা ও প্রযুক্তিবিদ্যার সুফলতা লাভ করতেন । অতএব , প্রাচ্য পাশ্চাত্যের সেতু বন্ধন ছিল খুবই কঠিন কাজ । কিন্তু স্বামীজীর চেষ্টা অনেকটা সফল হয়েছিল । ক্রিস্টোফার ইশারউড ছিলেন একজন ভক্ত ও বিশিষ্ট ব্যক্তি । তিনি বলতেন , স্বামীজী এসেছিলেন প্রাচ্য – পাশ্চাত্যের মধ্যে সেতু তৈরি করতে । বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর , স্বামীজী সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন বিবেকানন্দ পূর্ব ও পশ্চিমকে দক্ষিণে ও বামে রাখিয়া মাঝখানে দাঁড়াইতে পারিয়াছিলেন । গ্রহণ করিবার , মিলন করিবার , সৃজন করিবার প্রতিভা তার ছিল । আমরা জানি , জাগতিক বস্তুর দ্বারা তৈরি সেতু এক সময় ফাটল ধরে ও ভেঙে যায় । কিন্তু স্বামীজী প্রাচ্য পাশ্চাত্যের মধ্যে চিন্তা প্রেম ও আধ্যাত্মিকতার সেতু তৈরি করে গিয়েছেন ।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.