প্রাণহীন অচলায়তন!

 প্রাণহীন অচলায়তন!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

রাজ্য সরকার ১৪ লক্ষ মানুষের ক্ষয়ক্ষতির কথা বলিতেছে।মুখ্যমন্ত্রী অশেষ বেদনা জানাইয়া নানান জায়গায় বলিয়াছেন,যে ক্ষতি হইয়াছে তাহার পূরণ আগামী তিন বৎসরেও সম্ভব নহে।অনেকে হয়তো ভাবিতে বসিবেন, মুখ্যমন্ত্রী তিন না বলিয়া দুই কিংবা চার কেন বলিলেন না?তাহারা হাতের কড়ে গুনিবেন,তিন বৎসর পর কোনও ভোট আসিতেছে কিনা।সে অন্য গল্প।আজ সকলেরই ভাবনা হওয়া দরকার,বন্যার্ত মানুষগুলির পাশে কী প্রকারে দাঁড়ানো যাইতে পারে।কী মতে এইসকল মানুষগুলির পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হইতে পারে!এই সরকার এবং সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বারংবার বন্যার ভয়াবহতাকে অভূতপূর্ব বলিয়াছেন।কিন্তু এই রকম বলার পর সরকার কী ভূমিকা লইয়াছে বা লইতেছে তাহা কেউ জানিতে বা শুনিতে পান নাই।বরং প্রশাসনের কার্যকলাপ দেখিলে মনে হইবে তাহারা আর্ত মানুষগুলির কথা ভাবিবার শক্তি হারাইয়া ফেলিয়াছেন। রাজ্যের প্রশাসন কেবলই এক নিষ্প্রাণ,জড়বস্তু মাত্র।
চল্লিশ লক্ষ মানুষের রাজ্যে ১৪ লক্ষ মানুষ যখন বিপন্ন হয় ইহাকে কী বলা হইবে? ত্রিপুরার এক তৃতীয়াংশ মানুষ আজ গভীর বিপন্নতার শিকার। এই বিপন্নতা লইয়া ভাবিবে না রাজ্যের সরকার? যদি ভাবিয়া থাকে তাহার প্রকাশ কি জনগণ দেখিতে পাইবে না?জলের তলায় ঘরদুয়ার চলিয়া যাইবার পর মানুষজন শিবিরে আসিয়া আশ্রয় লইয়াছিল।তাহাদের জন্য ডাল ভাতের, শুকনো চিড়া, খিচুড়ির আয়োজন করে প্রশাসন।এর বাহিরে প্রশাসনের আর কি কোনও তৎপরতা দেখিয়াছেন আর্ত মানুষ!হ্যাঁ দেখিয়াছেন বটে, সে হইলো ক্ষতিগ্রস্তের তালিকা আর ক্ষয়ক্ষতির জরিপ।সকল রিপোর্ট তৈয়ার করিয়াছে প্রশাসনের ব্যক্তিবর্গ।যাহারা এই সকল রিপোর্ট তৈয়ার করিয়াছেন তাহারাই এখন মানুষের কাছ হইতে মুখ লুকাইতেছেন।
কারণ আর্ত মানুষের প্রশ্নের জবাব প্রশাসনের নিম্নস্তরের এই সকল প্রশাসকদের নিকট নাই।প্রাকৃতিক দুর্যোগগ্রস্ত রাজ্য হিসাবে দিল্লীর ঘোষণাপ্রাপ্ত ত্রিপুরার এক তৃতীয়াংশ মানুষই শুধু নহে,তাহাদের ঘরের যে সকল গবাদি পশুকে জলের স্রোত হইতে রক্ষা করা গিয়াছিল সেই সকল প্রাণীগুলিও আজ একটু একটু করিয়া মৃত্যুর দিকে আগাইয়া যাইতেছে, শুধুই খাদ্যাভাবে।যে কোনও বন্যার পর গবাদি পশুর খাদ্যের আকাল দেখা দেয়-এই কথা জানে যে কোনও ভুক্তভোগী মানুষ, সাধারণ স্কুলপড়ুয়াও। জানে না আমাদের প্রশাসন। যেই দলের সরকার আজ ডবল ইঞ্জিন চালাইতেছে সেই দল দিল্লী হইতে ত্রিপুরা, আর্যাবর্ত হইতে দাক্ষিণাত্য সর্বত্র গরুকে গোমাতা বলিয়া সম্বোধন করিয়া থাকে।অথচ এই দলের একটি সরকারের প্রাণীসম্পদ দপ্তর বন্যার্ত এলাকায় কোথাও দুর্ভিক্ষের শিকার পশুগুলির জন্য এক আঁটি খড় বিচালি লইয়া ভাবিবার অবকাশ পায় নাই।
এই প্রশাসনকে নিষ্প্রাণ না বলিলে কী বলা হইবে?রাজ্য জুড়িয়া শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যাজ্যোতি জ্বালাইয়া শিক্ষাক্ষেত্রে এক নব আলোকবর্তিকার ভগীরথ বলিয়া নিজেদের দাবি করিয়াছে যে সরকার সেই সরকারের কুশীলবেরা আজ নিঃস্ব ছাত্রদের হাতে পুস্তক তুলিয়া দিবার প্রয়োজনটুকুও ভাবিতে পারিতেছে না।বহু ছাত্রছাত্রীর বইখাতা ভাসিয়া গিয়াছে। সরকার তাহার শিক্ষানীতিতে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বিনামূল্যে বই দিয়া থাকে।সেই সকল বই সবে স্কুলে স্কুলে যাইতে শুরু করিয়াছে। দেখা গিয়াছে স্কুলগুলি যত সংখ্যায় বইয়ের প্রয়োজনের কথা বলিয়াছে তাহার সহিত দপ্তরের পাঠানো বইয়ের মিল নাই। অর্থাৎ প্রয়োজন মতন বই যাইতেছে না।
ইহার বড় কারণ বন্যা সরকারের সঙ্গে কথা বলিয়া শিক্ষাবর্ষে শুরুর মুখে আসে নাই, তাই প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত বই তাহারা ছাপাইয়া রাখিতে পারে নাই। ক্যালেন্ডার অনুযায়ী শিক্ষাবর্ষের শেষের দিক চলিতেছে।এই সময়ে খোলা বাজারে পাঠ্যবইয়ের মজুদ শেষ হইয়া যায়।আজকাল সকল পাঠ্যবই ছাপাইয়া থাকে এসসিইআরটি। তাহারা বই ছাপাইয়া বাজারে সরকার অনুমোদিত ভন্ডারের কাছে বই তুলিয়া দেয়।ভেন্ডার জানাইতেছে এই সময়ে এসসিইআরটির গুদামেও বইয়ের টান রহিয়াছে। তাই প্রয়োজনীয় বই চাহিয়াও তাহারা পাইতেছেন না। অন্যদিকে খোলা বাজারে বইয়ের যে পারস্পরিক কালোবাজারি হইয়া থাকে অর্থাৎ পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে রেফারেন্স বা নোটবই চাপাইয়া দেওয়ার সংস্কৃতি, উহা বন্যার বছরে পুরোদমে চলিতেছে।ফলে যাহারা খোলা বাজারে আসিতেছেন তাহারা ত্রিশ টাকার বইয়ের জন্য তিনশো টাকার রেফারেন্স বই কিনিতে বাধ্য হইতেছেন। বিশেষ করিয়া নবম হইতে দ্বাদশ অবধি ছাত্রদের বই সরকার দেয় না, অভিভাবকেরাই কিনিয়া থাকে।সেপ্টেম্বরে স্কুলের পরীক্ষা পিছাইয়া দেওয়া হইলেও স্কুলগুলিতে ক্লাস শুরু হইয়াছে।অনেক ছাত্রছাত্রী বন্যার পর আর নতুন স্কুল পোশাক কিনিতে না পারিয়া অন্য পোশাকেই স্কুলে আসিতেছে।আবার অনেকে এখনো আসিতে পারে নাই।যাহার আসিয়াছে বা যাহারা আসে নাই তাহাদের সিংহভাগের হাতেই বই নাই।সেপ্টেম্বরের জায়গায় পিছাইয়া নভেম্বরে হইলেও পরীক্ষা হইবে।কিন্তু তাহারা লিখিবে কী?এর নির্মম পরিণতি হইতে পারে ড্রপ আউট।পাইকারি হারে ছাত্রছাত্রী স্কুলছুট হইয়া গেলে কাহারো কি কিছু আসে যায়?
যে প্রশাসন সব জানিয়াও ছাত্রদের হাতে বই দিবার স্বার্থে তাহার নীতি শিথিল/বদল করে না অভূতপূর্ব ভয়াবহ বন্যার বছরেও, বুভুক্ষু বোবা প্রাণীগুলিকে বাঁচাইতে কোনও ভাবনাই ভাবিতে পারে না যে সরকারের প্রাণীসম্পদ দপ্তর, তাহাদের তো ছাত্রছাত্রীদের স্কুলছুট লইয়া উদ্বিগ্ন হইবার কোনও কারণই থাকিতে পারে না।প্রশাসন এখন বন্যার্ত মানুষের চাইতে মায়ের বিদায় লইয়া অধিক ভাবিত। প্রায় চার দশকের ব্যবধানে দুর্গাপূজার প্রতিমা নিরঞ্জনে একটি যূথবদ্ধ শোভাযাত্রার নাম মায়ের বিদায়। গত বছর চার ধরিয়া ইহা চলিতেছে বিজয়া দশমীর পর এক্সটেন্ডেড শব্দদূষণ হিসাবে।বলা হইয়া থাকে প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গে কার্নিভ্যাল নাম দিয়া যূথবদ্ধ যে শোভাযাত্রা তাহার অনুকরণেই আগরতলায় মায়ের বিদায় শুরু করা হইয়াছে।কিন্তু এই কথা সর্বাংশে বিশ্বাসনীয় নহে। কলকাতায় প্রতিটি মূর্তি বা প্রতিমার সঙ্গে আলাদা আলাদা থিম লইয়া কমিটিগুলি প্রতিযোগিতামূলক সাংস্কৃতিক, সাংগীতিক পরিবেশনা লইয়া আগাইয়া যায়। আর আগরতলায় সকল কমিটির একটাই প্রতিযোগিতা, উচ্চগ্রামের স্বরনিক্ষেপণ যন্ত্র সহকারে উদবাহু নৃত্য। ব্যবহৃত সঙ্গীত সকলের ক্ষেত্রে একরকম হইলেও আপত্তি নাই।
প্রশ্ন আসিতেছে,দেবীর আবাহন, অধিবাস, নবপত্র, কল্পারম্ভ, পূজাপ্রশস্তা ইত্যাদি আমাদের জন্য যেই মতে জরুরি মায়ের বিদায় কি সেই পর্যায়ের?অভাবনীয় জনদুর্ভোগের বৎসরে আতিশয্যহীন উদযাপন কি সম্ভব নহে?বাড়তি খরচ কি তাহাদের জন্য বরাদ্দ করা যাইতে পারে না? সেই সকল মানুষকে চরম দুর্ভোগের অন্ধকারে রাখিয়া মায়ের বিদায় মঞ্চে আলো করিয়া বসিয়া থাকা কাহাদের আলোকিত করিবে?প্রশাসন কি এই বৈষম্যের কথা ভাবিবে না? প্রশাসনও কি সত্যই এক প্রাণহীন অচলায়তন?

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.