প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির ঘড়া

 প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির ঘড়া
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন-সহ পশ্চিমি দুনিয়ার তাবড় নেতারা এক মঞ্চে উপস্থিত থেকে ভারতের পৌরোহিত্যে যৌথ ঘোষণাপত্রে সম্মত হলেন, এ নি:সন্দেহে দেশের পক্ষে এক গৌরব মুহূর্ত। জি ২০ মূলত অর্থনৈতিক মঞ্চ, ভূকৌশলগত বা নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয় মীমাংসার জায়গা নয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক অর্থনীতির উপরে এর প্রভাব পড়ছে বলেই ইউক্রেন যুদ্ধ সম্পর্কে উদ্বেগ বিস্তারিতভাবে তুলে ধরে সভাপতি হিসাবে একটি আন্তর্জাতিক ঘোষণাপত্রে জি ২০-র ঐকমত্য আদায় করে নিয়েছে ভারত। দিল্লী বিবৃতি নি:সন্দেহে ভারতের পক্ষে বড় কূটনৈতিক জয়।তবে তাৎপর্যপূর্ণভাবে কোনও রাষ্ট্র ইউক্রেনের সঙ্গে একতরফাভাবে যুদ্ধ শুরু করেছে, ঘোষণাপত্রে তারও কোনও উল্লেখ নেই। কোথাও রাশিয়ার নামগন্ধ রাখা হয়নি। সামগ্রিকভাবে এই ঘোষণাপত্র থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, বিশ্বের প্রথম কুড়িটি অর্থনৈতিক শক্তির দেশ প্রত্যেকেই নিজেদের স্বার্থে জাতীয় স্বার্থ রক্ষার দিকটিকে বাঁচিয়ে রাখতে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ কূটনীতি নিয়ে চলেছে। ভারতও এই কূটনীতির বাইরে নয়। সত্যিটা হলো, আমেরিকা এই কূটনৈতিক অবস্থানে ততদিন পর্যন্ত শরিক থাকবে যতদিন তাদের সামরিক সরঞ্জাম-সহ আনুষঙ্গিক আধুনিক পণ্যের বিক্রির বাজার ভারতের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ বাজার হলো সামরিক সরঞ্জাম। দ্বিতীয় স্থানে ট্যুরিজম এবং তৃতীয় স্থানে ফার্মা। এই তিন ক্ষেত্রেই ভারত ক্রমবর্ধশীল বাজার।
সভাপতি দেশ হিসাবে এই জি ২০ থেকে ভারত কী পেলো, সেগুলি কতটা গ্রহণযোগ্য এবং বিশ্বাসযোগ্য, ৪,১০০ কোটি টাকা খরচ করে এই রাজসূয় মন্থনের পর কী অমৃত পেলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, সেসব পৃথক প্রশ্ন। ভাবীকাল তার উত্তর দেবে। এক্ষণে একটি জরুরি বিষয় এই অবকাশে আলোচিত না হলে তা হবে অনুচিত। ভারতমণ্ডপমের মঞ্চে ভূরাজনীতির দুই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র চিনের প্রধান শি জিনপিং এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে দেখা গেল না। ইউক্রেন আগ্রাসনের পর পশ্চিমের শীর্ষনেতাদের তোপ এড়াতে পূর্বের বহু গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকেই পুতিন যেমন অনুপস্থিত থেকেছেন, এবারও তাই করেছেন।অন্যদিকে, ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বিবাদ জিইয়ে রাখতে পরিকল্পিতভাবেই চিনের সর্বাধিনায়ক নয়াদিল্লীতে আসেননি বলেই ধরে নেওয়া হচ্ছে। এর ফলে, জি ২০-র প্রেসিডেন্ট পদটিকে ব্যবহার করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির নেতৃত্ব আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে যতখানি সম্প্রসারিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, তা হলো না। একদিক থেকে অধরাই থেকে গেল। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম দুই চরিত্র সরে থাকলে, বিশ্বশক্তিগোষ্ঠীর মাহাত্ম্যও অনেকাংশে কমে যায়। তার উপরে ভারতের পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে কারণ রাশিয়া এবং চিনের কৌশলগত আঁতাত।রাশিয়া ভারতের সর্বাধিক প্রাচীন শক্তিমান মিত্র রাষ্ট্র। অথচ পরবর্তীকালে ভারতের সঙ্গে যাদের বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে, বিশেষত আমেরিকা-সহ পশ্চিমি তথা ‘নেটোভুক্ত’ দেশগুলি রাশিয়া ও চিনের উপরে আরও কঠোর পদক্ষেপ করতে উদ্যত। বাণিজ্য, প্রযুক্তি এবং ভূরাজনৈতিক বিবাদের সূত্রে চিনের উপরে চাপ বাড়িয়ে চলেছে আমেরিকা। ফলস্বরূপ তাদের উন্নত মাইক্রোকন্ডাক্টর বা চিপ, যা চিন নিজেদের সামরিক ক্ষেত্রে ব্যবহার করে বলে মনে করা হয়, সেগুলি আর সরবরাহ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। অপরদিকে অস্ত্র সাহায্য করে রাশিয়াকে যুদ্ধে পরোক্ষ মদত দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে চিনের বিরুদ্ধে। ভারতের কাছে এই পরিস্থিতি অনেকটা শাঁখের করাতের মতো। একদিকে যেমন এশিয়ায় চিনের আধিপত্য বিস্তার রোধে ভারতের আমেরিকার সহায়তা প্রয়োজন, তেমনই সামরিক স্বার্থে তাকে রাশিয়ার সঙ্গেও সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দুই তরফকে সামাল দেওয়ার এই ট্রাপিজের খেলায় ভারতের অবস্থান আগামীদিনে আরও কঠিন হয়ে পড়বেই। ফলে দুই রাষ্ট্রনেতার অনুপস্থিতির বিষয়টি বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর যতই গুরুত্ব না দেওয়ার চেষ্টা করুন না কেন, ভারতের তত্ত্বাবধানে এই মহাসম্মেলনে সাফল্যের ঘড়া অনেকখানি পূর্ণ হলেও বেশ কিছুটা অপূর্ণও রয়ে গেল। এই ঘোষণাপত্র থেকে শুধু যুদ্ধ নয়, পরিবেশের মতো বৈশ্বিক বিষয়ে জি ২০ দেশগুলি কতটা বেঁধে বেঁধে থাকবে, সেই নিয়েও প্রশ্ন থাকছে।

May be an image of 2 people, dais and text
Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.