ফলন্ত গাছ ঝুঁকে থাকে

এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

জনগণের ভোটে নির্বাচিত একটা গণতান্ত্রিক সরকার কতটা জনমুখী এবং জনকল্যাণকারী ভূমিকা নিতে পারছে,তার মাপদন্ড নির্ধারিত হয় সেই সরকারের কাজের ধরন,জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং সংবেদনশীলতার উপর। রাজ্যে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতাসীন হওয়ার পর মাত্র দুই মাসের সামান্য কিছুটা বেশি সময় অতিক্রান্ত করেছে মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহার নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার।তার আগে বিধানসভা ভোটের ঠিক দশ মাসের মাথায়,এক জটিল রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে আচমকাই মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসতে হয়েছিল ডা. মানিক সাহাকে।সেই হিসাবে দুই পর্ব মিলিয়ে গত ১৫ মে মুখ্যমন্ত্রিত্বের কার্যকালের এক বছর পূর্ণ করলেন মানিক সাহা। একজন রাজনীতিবিদের কাছে এক বছরের মুখ্যমন্ত্রিত্বকাল সেই অর্থে কোনও বড় ঘটনা নয়।কিন্তু প্রবহমাণ সময়কে তার রাজনৈতিক গুরুত্ব ও অবস্থান থেকে মূল্যায়ন করলে এক বছরের সময়কালকে রাজ্যের দিক নির্ণয়কারী মাইলস্টোন হিসাবে বিশ্লেষণ করা মোটেই অন্যায্য হবে না।রাজ্যে প্রথমবারের মতো বিজেপি সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মাত্র চার বছরের মধ্যেই বিভিন্ন কারণে সরকারের ভূমিকা ও কাজকর্ম নিয়ে সাধারণের মনে সরকার সম্পর্কে একটা বিরূপ ভাবনার জন্ম নিয়েছিল।যার কারণে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের আস্থা হারান তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী।এই জটিল রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণেই বিধানসভা ভোটের মাত্র দশ মাস আগে ডা. মানিক সাহার কাঁধে গুরুদায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়।সেই থেকেই ভোটমুখী ত্রিপুরায় একদিকে দল এবং অপরদিকে সরকার, দুইয়েরই ড্যামেজ কন্ট্রোলের প্রধান মুখ হয়ে উঠেন ডা. মানিক সাহা।চিকিৎসক ও আদ্যোপান্ত ভদ্রলোক ভাবমূর্তির মানিক সাহা অচিরেই ঘরে বাইরে নিজের আচরণ, ভূমিকায় নিন্দুকদের মুখ বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।যার ফল হিসাবে দিল্লীর দলীয় নেতৃত্ব হাতেনাতে ২০২৩ -এর বিধানসভার ভোটে ফসল তুলতে পেরেছিলেন। রাজনীতিতে একটা কথা প্রায়শই বলা হয়ে থাকে যে,অল্প সময়ে ক্ষমতার অলিন্দে থেকেও মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করা সম্ভব, যদি সেই রাজনৈতিক ব্যক্তিটি সততা ও মানবিক দৃষ্টিকোণ দ্বারা পরিচালিত হন। এই আপ্তবাক্যটি যে কতটা সত্য তা মাত্র এক বছরের সময়কাল দিয়েই দৃষ্টান্ত হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন মুখ্যমন্ত্রী ডা.সাহা। বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক সন্ত্রাস, মাফিয়া হুজ্জতি,বাইক বাহিনী সংস্কৃতি, নেশা কারবারিদের বিরুদ্ধে বাস্তব অর্থেই জিরো টলারেন্স নীতি — উল্লেখিত প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষের মনে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে যে আস্থা ও বিশ্বাসের ভিত তিনি গড়ে তুলেছেন তা এককথায় সরকারের দৃষ্টান্তমূলক দিক।এটা শুধুই সরকারের প্রধান হিসাবে মুখ্যমন্ত্রীর স্বচ্ছতা ও আন্তরিকতার খোলামেলা আচরণের প্রকাশ নয়।এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে গোটা সরকারের কাজ করার দৃষ্টিভঙ্গি ও নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি।মনে রাখতে হবে, একটা সরকার এবং প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও সততা তখনই সাধারণ মানুষ উপলব্ধি করতে পারেন, যখন সরকার সংবেদনশীল মন নিয়ে মানুষের পাশে দাড়ায়। একটা সরকার যখন নিজের জ্ঞান ও দক্ষতার মাধ্যমে প্রতিটি নাগরিকের সঙ্গে সম্ভ্রমের আচরণ করে,তখন সেই সরকারের বল, সাহস ও শক্তি আধাসামরিক বাহিনীর জওয়ানদের মতোই দাপুটে এবং কার্যকরী হয়। সুশাসনের দাবি নাগরিকদের সব সময়ই মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে।কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়,সরকার গাছাড়া মনোভাব নিয়ে কাজ করায় জনগণের তাতে বিশেষ কোনও উপকার হয় না।মনে রাখতে হবে, বাহ্যিক জৌলুস আর আড়ম্বরতার চেয়ে অন্তরের আর্তিটাই হল মূল কথা।তাই সঠিক কাজ করতে গিয়ে কোনও রকম দ্বিধা থাকা উচিত নয়।বরং সিদ্ধান্তে অবিচল,নিষ্ঠা ও সততা থাকা দরকার।সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি এড়িয়ে চলা বা তা নিয়ে বিলম্ব করা শাসনব্যবস্থাকে যেমন দুর্বল করে,তেমনি সরকারকে জনগণের থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে যদি কেউ দ্বিধাগ্রস্ত থাকেন বা ঝুঁকি ও দায়িত্ব নিতে ভয় পান,তাহলে সাধারণ নাগরিককে এর দূর্বিষহ যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। সরকার যদি কোনও কিছু তার দায়িত্ব এড়িয়ে যায়, তাহলে এর ফল মারাত্মক হতে পারে যা সুশাসনের জন্য মোটেই ভালো লক্ষণ নয়।প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের একটি মূল্যবান বক্তব্য এ প্রসঙ্গে খুবই প্রণিধানযোগ্য।উইলসন বলেছিলেন; সংবিধান রচনা করা সহজ, কিন্তু সেটা রূপায়ণ করা কঠিন।প্রতিশ্রুতি বিলানো সহজ, কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি রূপায়ণ করা ততটাই জটিল।এই কঠিন বাস্তবের সঙ্গে সরকার যত নিজেকে আত্মস্থ করতে পারবে,ততই অতীতের এই ধরনের বিচ্যুতি এবং প্রতিবন্ধকতা থেকে রাজনীতিকে দূরে রাখা সম্ভব হবে।না হলে সবটাই সরকারের দ্বিচারিতায় পর্যবসিত হবে।মুখ্যমন্ত্রী ডা. মানিক সাহার নেতৃত্বাধীন সরকারের বর্ষপূর্তিতে আরেকটি কথা বলা প্রাসঙ্গিক।দেশের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ১৯৪৯ সালের অক্টোবরে এক সম্মেলনে বলেছিলেন, “আমি মনে করি,যদি কেউ সৎ ও সঠিক মতামত জানাতে না পারেন,তাহলে সেই ব্যক্তি পরোক্ষে সরকারের ক্ষতি করছেন।খোলাখুলি মত প্রকাশে আমি অসন্তুষ্ট হই না।বরং আমি আমার সচিবদেরও বলেছি যারা সত্য গোপন করেন তারা চাকরি ছেড়ে যেতে পারেন।কারণ বাক্‌স্বাধীনতা ছাড়া সত্যকে জানা যাবে না।”রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তব্যের মধ্যেও এই সুরই ধ্বনিত হতে শোনা গেছে।দায়বদ্ধতা ও সংবেদনশীল মন ছাড়া একটি সরকার ও প্রশাসন যে মানুষের মন থেকে হারিয়ে যায়,সরকার তার মূল ভাবনা ও পথচলা থেকে বিচ্যুত হয়-মুখ্যমন্ত্রী সেই বার্তাও দিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। নিঃসন্দেহে এটা সরকারের ইতিবাচক উপলব্ধি।ধৈর্য ধরে, যত্ন সহকারে মানুষের মনের কথাগুলো যেমন সরকারকে শুনতে হবে,তেমনি নাগরিকের বিভিন্ন মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করতে হবে। এটাই হচ্ছে যে কোনও সরকারের জন্য শেখার সবচেয়ে ভালো ও কার্যকরী উপায়।ফলন্ত গাছ সবসময় মাটির দিকে ঝুঁকে থাকে।ফলের ভারে গাছের মধ্যে ঔদ্ধত্ব থাকে না।যা থাকে সেটা হল বিনয়। অতীতে বিভিন্ন সময়ে এ রাজ্যের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে শাসকের মধ্যে ছন্দপতন ঘটতে দেখা গেছে।কিন্তু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মাত্র এক বছরের কার্যকালেই যে শিষ্টাচার, সৌজন্যতা, সহনশীলতার পাঠ রাজ্যবাসীর সামনে রেখে চলেছেন তা অবশ্যই এই রাজ্যের গণতন্ত্রকে সমৃদ্ধ করবে।এটাই এই রাজ্যের সাম্প্রতিক রাজনীতির উল্লেখযোগ্য গুণগত সাফল্য।

Dainik Digital

Recent Posts

এ কে-৪৭ ও প্রচুর কার্তুজ সহ ৬ বৈরী ধৃত মিজোরামে, চাঞ্চল্য!!

অনলাইন প্রতিনিধি:- বাংলাদেশ থেকে কাঞ্চনপুর মহকুমার ভারত- বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে মিজোরামে যাওয়ার পথে মামিত জেলার…

19 hours ago

ফাইফরমাশ খাটছেন টিএসআর জওয়ানরা !!

অনলাইন প্রতিনিধি :- নিরাপত্তার কাজে নয়, টিএসআর জওয়ানদের খাটানো হচ্ছে আর্দালি হিসাবে। পুলিশ আধিকারিকদের ও…

19 hours ago

ইন্ডিগো আরও একটি দিল্লীর বিমান চালু করছে!!

অনলাইন প্রতিনিধি :- ইন্ডিগো আগরতলা- দিল্লী রুটের উভয় দিকে যাতায়াতে আরও একটি বিমান চালু করছে।…

19 hours ago

ইন্দ্রপ্রস্থে ভোট!!

দিল্লীর বিধানসভা ভোট নিয়ে সরগরম দিল্লী। দিল্লীতে এবার এক আঙ্গিকে বিধানসভা ভোট হচ্ছে। গত পরিস্থিতির…

19 hours ago

বহিঃরাজ্যে গেল “ধানি লঙ্কা”ওরফে ধান্না মরিচ!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-ত্রিপুরায় উৎপাদিত" অর্গানিক বার্ড আই চিলি " স্হানীয় ভাষায় যাকে বলা হয় ধানি…

2 days ago

কুম্ভ ইকনমি

২২জানুয়ারী,২০২৪।এক বছরের ব্যবুধানে ২০২৫ সালের ১৩ জানুয়ারি।গত বছরের মেগা ইভেন্টের আসর বসেছিল অযোধ্যায়। এবার মেগা…

2 days ago