ফুলে’ কুঠারাঘাত!!

এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

রাজা রামমোহন, বিদ্যাসাগর, নবগোপাল মিত্র, কেশবচন্দ্র সেন, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বেগম রোকেয়া, প্রমথনাথ চট্টোপাধ্যায়, বাংলার বুকে সমাজ সংস্কারক মনীষীর অভাব নেই। তবে বাংলার মতো এ ক্ষেত্রে এমন সৌভাগ্য বহির্ভারতের ততটা হয়নি। এর মধ্যে উল্লেল্লখযোগ্য ব্যতিক্রম জ্যোতিবা ফুলে ও তার পত্নী সাবিত্রীভাই ফুলে। সেই উনবিংশ শতাব্দীর ভারতে বর্ণপ্রথা ও অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ, নারী এবং নিপীড়িত সমাজের মধ্যে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে ফুলে দম্পতির আজীবন সংগ্রামের কাহিনী আজও চলমান বিস্ময়।ভারতের প্রাচীন বর্ণাশ্রম প্রথায় ফুলে পদবীধারীদের শূদ্র শ্রেণীতে রাখা হতো। সেই জায়গা থেকেই এক অসম লড়াই শুরু ফুলে দম্পতির। জ্যোতিবা ও সাবিত্রীর জীবন সংগ্রামের উপর পরিচালক অনন্ত মহাদেবন একটি সিনেমা তৈরি করেছেন। ‘ফুলে’ শীর্ষক ছবিটির মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল গত ১১ এপ্রিল। কিন্তু বিতর্কের আবহে ছবি মুক্তির দিন পিছিয়ে আপাতত ২৫ এপ্রিল। উত্তর ও পশ্চিম ভারতের বর্ণহিন্দু সমাজের তরফ থেকে ছবি মুক্তির আগেই গেল-গেল রব তোলা হয়েছে। ঘটনাচক্রে, হিন্দু সমাজের উচ্চবর্ণের এই মনুবাদী ভোটব্যাঙ্ক পদ্মের ঝুলিতেই সংরক্ষিত বলে গড়পড়তা ধারণা। ফুলে-র মুক্তিতে আপাতত এটাই বড় বাধা। এমন কথাও ছড়িয়েছে যে, ফুলে দম্পতির জীবনের লড়াই বিকশিত ভারতের সামনে কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারে। দেশের এই কালজয়ী সমাজ সংস্কারক দম্পতির বায়োপিক প্রেক্ষাগৃহে আসার আগেই মুখ থুবড়ে পড়ায় প্রশ্ন জাগছে, তবে কি সংবাদমাধ্যমের একাংশ এবং আইনসভার মতো ভারতীয় সিনেমার সেন্সর বোর্ডও অধুনা অপারেশন লোটাসের অন্তর্ভুক্ত? ব্রাহ্মণ্যবাদের আপত্তির কাছেই কি মাথা নত করেছে সেন্সর বোর্ড?
সামান্য একটা সিনেমা নিয়ে উচ্চবর্ণের ভোটব্যাঙ্কের কেন এত আপত্তি? উচ্চবর্ণের ভোট মানেই শত শতাংশ শাসকের ভোট, এমন কোনও পোক্ত প্রমাণ নেই। যদি সেটা হয়েও থাকে, তারাই কি সমাজের জ্যাঠামশাই? কেন শুনতে হবে তাদের কথা? বহুত্বের ভারতে সংখ্যালঘুরা অপরায়নের শিকার, তা যদিও মানা গেল, কিন্তু একরৈখিক ব্রাহ্মণ্যবাদের দর্পিত আগ্রাসনে ‘ফুলে’-র উপর এমন অদৃশ্য কুঠারাঘাত মানতে কষ্ট হয় বৈকি। দেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চারণভূমিতে অনেক দিন ধরেই মেরুকরণের জোরালো হাওয়া বহমান। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে হিংসার বলি হয়েছেন তিন ব্যক্তি, যাদের দুজন বৃদ্ধ পিতা ও পুত্র হিন্দু, তৃতীয় জন অ-হিন্দু। শুভেন্দু অধিকারীরা মৃত পিতা-পুত্রকে ‘হিন্দু শহিদ’ আখ্যা দিয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। শহিদের মধ্যেও মুসলিম খ্রিস্টান ভেদ করা, দশ-পনেরো বছর আগেও এ দেশ ভাবতে পারেনি। দুঃসাহস দেখিয়ে ক্ষুদিরাম বসুকে হিন্দু শহিদ, ভগৎ সিংকে শিখ শহিদ, দশ বছর আগেও বলতে পারেনি কেউ। বাংলা ভাষার জন্য লড়াইয়ের যে তরুণ ছেলেগুলি ঢাকার রাজপথে শহিদ হয়েছিলেন, অপরায়নের রাজনীতিতে আজ কি আমরা তাদের ‘মুসলিম শহিদ’ আখ্যা দেব। বঙ্গের বিরোধী দলনেতা বিজেপির শুভেন্দুর জেলারই মানুষ ছিলেন ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর। যার জীবনে, কর্মকাণ্ডে, লেখায়, কোথাও হিন্দু-মুসলমান দূরের কথা, উচ্চ-নীচ, ব্রাহ্মণ-শূদ্রে কোনও বিভাজন রেখা ছিল না। একটা গণতান্ত্রিক দেশের এভাবে, এত দ্রুত লয়ে আমূল বদলে যাওয়া কতটা নেতিবাচক বা কতটা ইতিবাচক পরিণাম, সময় তার উত্তর দেবে। তুর্কি আক্রমণ কিংবা মোগল শাসন, শুধু মুসলিমরাই এদেশে শাসনা করেনি। ওই দৃষ্টিতে দেখলে ইংরেজ তথা ক্রিশ্চানরা বহু বছর এ দেশ শাসন করেছে। ভারতবর্ষে হিন্দুদের মধ্যেই রয়েছে নানা স্তর বিভাজন। সাদা চোখে চারটি শ্রেণী-ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র হিন্দু সমাজ শত বর্ণে বিভক্ত, সেই সুযোগ নিয়েই বাধাবন্ধনহীন এ দেশের ৯০ শতাংশ হিন্দু সমাজের নিম্নবর্ণের মানুষকে শাসন করেছে উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা। শতধা বিভক্তির হিন্দু সমাজের উচ্চবর্ণের অত্যাচারের ইতিহাসের তথ্য সামনে আনলেই বুঝি ঘেঁটে যায় মনুবাদী রাজনীতির আখ্যান! ফুলে ছবিতে এই বিষয়গুলিকেই সামনে আন হয়েছে। ফুলে দম্পতি উচ্চবর্ণের বাধা অতিক্রম করে কীভাে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কীভাবে নারীদের সম্মা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, বিশেষত নিম্নবর্ণের বেটিদের জন্য নিজেদে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমৃত্যু লড়াই করেছিলেন, এই ছবিতে সেট দেখাতে চেয়েছেন পরিচালক। হিন্দু ধর্মের উদারতার দিকটিকে না সবিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এই ছবিতে। ঠিক এখানেই ব্রাহ্মণ্যক ভোটব্যাঙ্কের আপত্তি। কারণ, উদারতার একটা জায়গা তৈরি হলে মেরুকরণ রাজনীতির আখ্যান যে দুর্বল হয়ে পড়ে!

Dainik Digital

Share
Published by
Dainik Digital

Recent Posts

যান স্বল্পতায় বিলম্বিত বিমান যাত্রীরা রাতে দুর্ভোগে পড়েন!!

অনলাইন প্রতিনিধি :- অনেক রাতে এমবিবি আগরতলা বিমানবন্দরে বিলম্বিত বিমান যাত্রীরা আবারও যানবাহনের অভাবে চরম…

8 hours ago

এআরসি প্রযুক্তির চাষে স্বনির্ভরতার পথে রাজ্য!!

অনলাইন প্রতিনিধি:- রাজ্যে কৃষিক্ষেত্রে এক নতুন বিপ্লবের সূচনা করেছেন রাজ্যের কৃষি ও কৃষক কল্যাণ দপ্তরের…

8 hours ago

অপারেশন টেবিলে তিন প্রসূতি বিদ্যুৎ উধাও, তেল নেই জেনারেটরে!!

অনলাইন প্রতিনিধি:- মেলাঘরস্থিত মহকুমা হাসপাতালে সিজারিয়ান অপারেশন করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন চিকিৎসক। শুক্রবার বেলা বারোটা…

8 hours ago

নারীদের সাথে অসভ্যতা বরদাস্ত নয়, কংগ্রেস বিধায়কের বক্তব্য ভিত্তিহীন হাস্যকর: প্রদ্যোত!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-রাজ্যে মহিলা- মা-বোনদের সাথে অনৈতিক আচরণ হলে, এর সাথে জড়িত একজনকেও ছাড় প্রদান…

1 day ago

এ কেমন পুনর্বাসন!!

এশিয়ার বৃহত্তম বস্তি মুম্বাইয়ের ধারাভি। ৬০০ একর এলাকা নিয়ে তার বিস্তার। সত্তর-আশি বছর ধরে ধারাভি…

1 day ago

আইজিএম হাসপাতালে,নিম্নমানের খাবার সরবরাহ বিপাকে রোগী, ক্ষোভ!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-রাজ্যের সরকারী হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসার জন্য যেসব অসুস্থ রোগী ভর্তি থাকেন সেসব অসুস্থ রোগীর…

1 day ago