ফের ভোটের তাস

 ফের ভোটের তাস
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

মহাত্মা গান্ধী থেকে মাও সে তুঙ—পৃথিবীর ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তি নানা পদ যাত্রায় অংশ নিয়েছেন। রাজনৈতিক প্রয়োজনেই হোক কিংবা ধর্মীয় কোনও অ্যাজেণ্ডাকে সামনে রেখে এই অভিযান সংঘটিত হয়েছিল।এই পদযাত্রার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।সূদূর অতীতে শঙ্করাচার্যও ভারতে পদযাত্রার আয়োজন করেছিলেন।ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ডাণ্ডি অভিযান কিংবা ভারত ছাড়ো আন্দোলন সহ বেশ কয়েকটি ইস্যুতে মহাত্মা গান্ধী পদযাত্রায় শামিল হয়েছেন।১৯৮৩ সালে তৎকালীন তরুণ তুর্কি বিরোধী নেতা চন্দ্রশেখর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জনজাগরণের ডাক দিয়ে পদযাত্রা শুরু করেছিলেন।

আবার ১৯৯০ সালে লালকৃষ্ণ আদবানি তাঁর ঐতিহাসিক রথযাত্রার মধ্যে দিয়ে গোটা আসমুদ্র হিমাচলজুড়ে রাজনৈতিক লড়াইয়ে নেমেছিলেন।সম্প্রতি পাকিস্তানের বিরোধী নেতা ইমরান খানও সে দেশে লংমার্চের সূচনা করেছেন।যাত্রা সে কতই ঘটেছে এই দুনিয়ার বুকে।পদযাত্রা হোক,রথযাত্রা হোক কিংবা রামযাত্রা।সব যাত্রাকে ছাপিয়ে গেছে চিনে মাওসে তুঙের ঐতিহাসিক লংমার্চ। এবার ভারতের কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী ভারত জোড়ো যাত্রায় নেমেছেন। রাহুলের এই লংমার্চ পুরোপুরিই রাজনৈতিক। যদিও যাত্রা শুরুর প্রাক্কালে তিনি বলেছেন এই ভারত জোড়ো যাত্রা ভোট রাজনীতি ওদল রাজনীতির অনেক ঊর্ধ্বে।

তার মতে গত ৮ বছরে নরেন্দ্র মোদির শাসনকালে বিজেপি দেশকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের নামে ভাগ করে যেভাবে দেশের ক্ষতি করেছে,এই ভারত জোড়ো যাত্রার মাধ্যমে সেই ক্ষতি পূরণ দেশকে আবার এক সুতোয় বাঁধতে এই কর্মসূচি নিয়েছে কংগ্রেস।অর্থাৎ টুকরো টুকরো ভারতকে জোড়া দিতে রাহুলের এই লংমার্চ।প্রায় আড়াই মাস হয়ে গেল রাহুল লংমার্চে দেশের রাজপথে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে হেঁটে চলেছেন।দক্ষিণের তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারী থেকে তিনি শুরু করেছিলেনএই পদযাত্রা।মোট ৫ মাসে দীর্ঘ ৩ হাজার ৫৭০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ১২ টি রাজ্যের উপর দিয়ে রাহুলের লংমার্চ শেষ হবে কাশ্মীরের শ্রীনগরে।

যাত্রার শুরু থেকেই তাতে অংশ নিয়েছেন রাহুল গান্ধী,সোনিয়া গান্ধী,জয়রাম রমেশ সহ দেশের নামীদামি বহু আলোচিত সেলিব্রেটিরা। এই যাত্রা নিয়ে প্রখর সমালোচনা হয়েছে বিজেপি দলের পক্ষ থেকে। রাহুলের পরনে টিশার্টের দাম থেকে শুরু করে এক বিতর্কিত খ্রীষ্টান যাজকের সাথে রাহুলের সাক্ষাৎ-সব বিষয়েই তোপ দেগেছে গেরুয়া শিবির। লক্ষণীয় হল, বিজেপি দল,তাদের আইটি সেল,অন্যান্য নেতৃবৃন্দ রাহুলের ভারত জোড়ো নিয়ে তুমুল সমালোচনা এবং ঠাট্টা তামাশা করলেও দলের প্রধান মুখ এই নিয়ে একটি শব্দও ব্যয় করেননি। পরোক্ষে বা কৌশলে দুই-এক কথা বললেও সরাসরি রাহুল ও ভারত জোড়ো যাত্রা নিয়ে এতদিন নীরব ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

কিন্তু সেই দীর্ঘ-নীরবতা ভেঙে রাহুলের লংমার্চের আড়াই মাসের মাথায় গান্ধী পরিবার, কংগ্রেস, রাহুল আর ভারত জোড়ো যাত্রাকে নিশানা করে তুমুল আক্রমণ হানলেন। বললেন,মানুষের প্রয়োজন নয়, ক্ষমতালিপ্সু একটা পরিবার ক্ষমতায় ফিরে আসার উগ্র বাসনা থেকে এই যাত্রায় নেমেছে।শুধু এখানেই থামেননি মোদি। সম্প্রতি মহারাষ্ট্রে ভারত জোড়ো যাত্রায় রাহুলের পাশে দেখা গেছে সমাজকর্মী মেধা পাটেকরকে। এখানেই আক্রমণ হানেন মোদি। গুজরাটের নর্মদা নদীর উপরে সর্দার সরোবর বাঁধ প্রকল্পের কাজ যারা আটকে দেয় কংগ্রেস তাদের নিয়েই ভারত জোড়ো যাত্রায় শামিল হয়েছে।

পাশাপাশি গুজরাটের ভোটের প্রচারে অংশ নেওয়ার কারণে রাহুল দুই দিনের ভারত জোড়ো যাত্রা বন্ধ রাখায় তাতেও সুর চড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন,আসলে বোঝাই যাচ্ছে অক্ষত ভারতকে কেন জোড়ার কথা বলে পথে নেমেছে রাহুল গান্ধীর দল।তাদের আসল লক্ষ্য তো ভোটে জেতা। আগামী ১ এবং ৫ ডিসেম্বর দুই দফায় নির্বাচনে ভোট নেওয়া হবে গুজরাটে।তার প্রাক্কালে গুজরাটের প্রচারে নেমে গান্ধী পরিবার ও ভারত জোড়ো যাত্রা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর এই আক্রমণ ও কটাক্ষ যে যথেষ্ট ইঙ্গিতবাহী ও তাৎপর্যপূর্ণ- সেই বিষয়ে রাজনৈতিক মহল মোটামুটি একমত।

ভোটের ফলাফলে রাহুলের ভারত জোড়ো যাত্রা কতটা প্রভাব ফেলবে সেটা আপেক্ষিক।কিন্তু এরই মধ্যে গত আড়াই মাসে ভারত জোড়ো যাত্রার অভিজ্ঞতা গেরুয়া শিবিরের জন্য যে ভালো স্বস্তির বার্তা নয় সেটা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই আভাস দিতে শুরু করেছেন।বিশেষ করে আগামী বছর দক্ষিণ ভারতের কয়েকটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের আগে রাহুলের লংমার্চ সাধারণ মানুষের মধ্যে কতটা প্রভাব বিস্তার করে তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক রয়েছে রাজনৈতিক মহলেই।

এই অবস্থায় গুজরাট নির্বাচনের আগে মেধা পাটেকরের কার্ড খেলে কংগ্রেসকে গুজরাট বিদ্বেষী তকমা দেওয়া কৌশলী মোদির জন্য কতটা সাফল্য বয়ে আনবে তা আগামী দিনেই স্পষ্ট হবে। কেননা ২০১২ সালে সোনিয়া গান্ধী ‘মওত কা সওদাগরের’ তাস এবং ২০১৪ সালে লোকসভা ভোটের আগে ‘নীচে রাজনীতির’ তাস প্রয়োগ করে হাওয়া ঘুরিয়ে দেওয়ার যে কূটকৌশল অবলম্বন করেছিলেন তা এবার মেধা পাটেকরের ভারত জোড়ো যাত্রায় অংশগ্রহণের তাসকে লুফে নিয়ে ভোটের বাক্সে কতটা প্রভাব ফেলা যাবে সেটাই এখন দেখার।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.