বহুমাত্রিক বৈষম্য

এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

নারী ও পুরুষের মধ্যে পূর্ণ সমতা অর্জনের জন্য সমাজকে নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূর করতে এগিয়ে আসতে হবে।কারণ লিঙ্গ সমতার নীতি আমাদের দেশের সংবিধানের মধ্যেও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।সংবিধানে লিঙ্গ সমতার নিশ্চয়তা এবং দেশকে নারীর পক্ষে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরেও আমাদের দেশে লিঙ্গ বৈষম্য দূর করা সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন পরিকল্পিত পদক্ষেপের মাধ্যমে নারীদের সামাজিক, শিক্ষাগত, আর্থিক এবং রাজনৈতিক বিকাশ ও উন্নতির লক্ষ্যে লিঙ্গ সমতা এবং মহিলাদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে একাধিক পদক্ষেপ গৃহীত হলেও প্রত্যাশার পূর্ণতা এখনো আসেনি। আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০-তেও লিঙ্গ সমতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। অথচ সামাজিক ভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে এখনো নারীরা লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার। আসলে আমাদের সামাজিক কাঠামোতে লিঙ্গ বৈষম্যের শেকড় অনেক দূর পর্যন্ত প্রোথিত। শুধু অর্থনীতি, শিক্ষা, সমাজ ও রাজনীতির মধ্যেই তা আবদ্ধ নয়। বরং নারীকে শব্দবন্ধ দিয়েও বিভিন্ন সময়ে বারবার আঘাত করা হয়। যা লিঙ্গ বৈষম্যের আরও কদর্য ও ভয়ানক পরিণামেরই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এই সমস্ত কদর্য শব্দ শুধু হাটে, বাজারে লিখিত আকারে, পাবলিক প্লেস বা জনবহুল অঞ্চলেই শুধু ব্যবহৃত হয় না। সরকারী কাগজপত্রেও অনেক ক্ষেত্রেই তা নজরে পড়ে। অথচ লিঙ্গ বৈষম্য নিয়ে চারিদিকে সমাজ, রাষ্ট্রনেতা থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবীরা অনেক প্রতিবাদে মুখর হলেও এই নিয়ে এতকাল কোন রা শব্দ মুখে তুলেননি। আমাদের সমাজ ও জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করে যে আদালত, সেই আদালতও কিন্তু এর থেকে মুক্ত নয়। আদালতে বিভিন্ন মামলায় শুনানির পর্বে কিংবা রায়দানের মধ্যেও এমন সব শব্দ কিংবা টীকা-টীপ্পনী স্থান পেয়ে যায় যা লিঙ্গ বৈষম্যের চরম হিংসাত্মক পরিণাম মাত্র। সেই ভূলগুলোরই এবার সংশোধন করতে উদ্যোগী হয়েছে দেশের শীর্ষ আদালত। এই লক্ষ্যেই দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট বিচারব্যবস্থার ক্ষেত্রে লিঙ্গ সচেতনতা গড়ে তুলতে এক বড়সড় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সম্প্রতি দেশের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় হ্যান্ডবুক অন কমব্যাটিং জেন্ডার স্টিরিওটাইপস’ শীর্ষক একটি বই প্রকাশ করেছেন। বইটি হল একটি বিশেষ সারগ্রন্থ, যাতে কোন কোন শব্দ আদালতে ব্যবহার করা যাবে না তার একটি তালিকা লিপিবদ্ধ রয়েছে। মাননীয় প্রধান বিচারপতি মনে করেন, আদালতও অনেক সময় বিভিন্ন মামলার শুনানির ক্ষেত্রে বা রায়দানের সময় গতানুগতিক শব্দ ব্যবহার করে। বিচার বিবেচনা না করেই এমন সব শব্দ প্রয়োগ করা হয় যা বাঞ্ছনীয় নয়। আদালতের কোন রায়ে ব্যবহৃত শব্দ কিংবা কোন সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কুৎসা বা সমালোচনার লক্ষ্যে নিয়ে এই সারগ্রন্থ রচিত হয়নি। বরং ভবিষ্যতে আদালতের কোন রায় বা শুনানির সময় ব্যবহৃত কোন শব্দ অথবা বিশেষ কোন বিচারপতির পর্যবেক্ষণ নিয়ে যাতে কোনও প্রশ্ন না উঠে,শব্দচয়ন নিয়ে যাতে কোন ধরনের আপত্তির সৃষ্টি না হয়, সেই অভিপ্রায় নিয়েই এই গ্রন্থ প্রনীত হয়েছে। এতে করে বিচারপতিরা যেমন শব্দচয়নের ক্ষেত্রে অনেকটাই সতর্ক হতে পারবেন তেমনি অবাঞ্ছিত বহু শব্দের প্রয়োগ বা ব্যবহার থেকে আদালত নিজেকে বিরত রাখতে পারবে। আদালত এখন থেকে কীকী শব্দ ব্যবহার করতে পারবে, কোন শব্দ ব্যবহার করতে পারবে না- এই সম্পর্কিত তালিকায় বইটিতে সুস্পষ্ট ধারণা দেওয়া হয়েছে। যেমন ‘ব্যভিচারিণী’ শব্দটির পরিবর্তে ব্যবহৃত হবে ‘বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হওয়া রমণী। ‘জন্মসূত্রে পুরুষ’ কিংবা ‘জন্মসূত্রে মহিলা’- এই শব্দগুলিতে প্রায়ই আদালতে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। এর পরিবর্তে লেখা হবে, জন্মকালে নির্ধারিত লিঙ্গ। শারীরিক মিলনের পরিবর্তে ‘যৌন মিলন’, পবিত্র নারীর পরিবর্তে ‘নারী’, চাইল্ড প্রস্টিটিউট-এর পরিবর্তে ‘পাচার হওয়া শিশু’, জোরপূর্বক ধর্ষণের পরিবর্তে ‘ধর্ষণ’, হাউস উয়াইফের পরিবর্তে হোম মেকার বা গৃহিণী, পরিত্যাক্তা পরিবর্তে শুধু ‘মহিলা’, চরিত্রহীন মহিলা শব্দটির পরিবর্তে ‘মহিলা’ এই রকম বহু শব্দবন্ধের উল্লেখ করা হয়েছে এই বইটিতে যা লিঙ্গ বৈষম্যেরই এক রূপ বলে মনে করছেন সর্বোচ্চ আদালত। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতির এই পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে এক আলোকদীপ্ত পদক্ষেপ। আসলে যুগ যুগ ধরেই অসংখ্য পক্ষপাতদুষ্ট এবং গতানুগতিক ধারার শিকার হয়ে আসছেন আমাদের সমাজের মেয়েরা। এই সমস্ত আচরণ, শব্দ, বাক্যবন্ধ, আচরণ কৌশলে আমাদের সমাজ ও বিচারব্যবস্থাতেও ন্যায্য এবং সমানাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে নারীদের। এবার বিচারব্যবস্থা থেকেই এর সংশোধন, ভাবনাচিন্তার পরিবর্তনের যে প্রয়াস নেওয়া হয়েছে তা গতানুগতিকতার শেকল ছেড়ে নারীকে নতুন সম্মান ও মর্যাদার যোগ্য স্থান দেবে এটাই প্রত্যাশা।

Dainik Digital

Share
Published by
Dainik Digital

Recent Posts

শুরু হলো পর্ষদের উত্তরপত্র মূল্যায়ন!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-ত্রিপুরা মধ্যশিক্ষা পর্ষদ পরিচালিত মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল এপ্রিল মাসের শেষে…

7 hours ago

টিএমসি কাণ্ড, ঋণ নিয়েছিলেন অধ্যাপিকা!তদন্ত চলছে, কাউকে ছাড়া হবে না বিধানসভায় কড়া বার্তা মুখ্যমন্ত্রীর!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-ত্রিপুরা মেডিকেল কলেজে ছাত্রছাত্রীদের পাস করিয়ে দেবার নাম করে ডা. সোমা চৌধুরী নামে…

7 hours ago

নিজেদের অধিকার রক্ষায় বৈঠকে যাচ্ছে টিএফএর আজীবন সদস্যরা।।

অনলাইন প্রতিনিধি :-রাজ্য ফুটবলের অভিভাবক সংস্থা টিএফএর সংবিধান সংশোধন করার নামে নিজেদের অধিকার কেড়ে নেওয়ার…

8 hours ago

এডিসির ৩০২ স্কুলে ১ জন করে শিক্ষক, ছাত্র সমস্যা নিরসনে সরকার আন্তরিক, বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী।।

অনলাইন প্রতিনিধি :-এডিসির ৩০২ টি স্কুলে শিক্ষক ১ রয়েছে।জাতীয় স্তরে প্রাথমিক স্কুলে ছাত্র- শিক্ষকের অনুপাত…

8 hours ago

কাজ করেনি,ফেরত গেছে ২২.৯১ কোটি টাকা,বাম আমলে অন্ধকারে ডুবে ছিল রাজ্যের পর্যটন: সুশান্ত।।

অনলাইন প্রতিনিধি :-বামফ্রন্টের টানা ২৫ বছরে রাজ্যের পর্যটন শিল্পের কোনও উন্নয়নই হয়নি। সম্পূর্ণ অন্ধকারে ডুবে…

9 hours ago

জাল ওষুধের রমরমা।

একা রামে রক্ষা নেই, সুগ্রীব দোসর। কথাটা বোধহয় এক্ষেত্রে একেবারে যথার্থভাবে ধ্বনিত হয়।গত কয়দিন ধরেই…

9 hours ago