বিভৎস ট্রেন দুর্ঘটনা, ছিটকে গেল চলন্ত তিনটি মালগাড়ির কামরা!!
বাবা-মাহাত্ম্য!!

১৪৪ বছর পর অমৃতকালের মহাকুম্ভ। ত্রিবেণী সঙ্গমে এমন মাহেন্দ্রক্ষণ স্বাধীন ভারতে এটাই প্রথম। স্বভাবতই এই মহাকুম্ভ সফল করা যোগী আদিত্যনাথের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। ইনিংসের সূচনাও হয়েছিল চমৎকার। কিন্তু দিন গড়ালে মেলাস্থলে আগুন লাগার একাধিক ঘটনা এবং মৌনী অমাবস্যার সকালে পদপিষ্ট হয়ে অনেক পুণ্যার্থীর মৃত্যুর পর স্নান করা এড়িয়ে যান সনাতনী সমাজ। এর ফলে তাদের দীর্ঘদিনের প্রথা পালনে ছেদ পড়ে। ফলে ধর্মপালন থেকে প্রশাসনিক দায়িত্বপালন, বিরোধীদের সমালোচনার জেরে এখন কার্যত ব্যাকফুটে আদিত্যনাথ। গেরুয়া বসনের মুখ্যমন্ত্রী ঘটনার অভিঘাতে সাময়িক ধাক্কা হয়তো খেয়েছেন, তাতে রাজনীতির কী হিত বা অহিত সাধন হয়েছে সে ভিন্ন প্রসঙ্গ, তবে এবার মহাকুম্ভের অন্যতম আকর্ষণ হয়ে উঠেছেন একাধিক ‘হাইটেক’ সাধুবাবা। নাগা সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনী থেকে শুরু করে সাত ফুট দীর্ঘ, সুঠামদেহী আত্মপ্রেম গিরি তথা ‘বিদেশি বাবা’ এবং সর্বোপরি অভয় সিং তথা আইআইটি বাবা। সোশ্যাল মিডিয়ায় তিনি যোগী আদিত্যনাথের চেয়েও আজকাল বেশি ‘ট্রেন্ডিং’। ভাল ছাত্র, ভাল চাকরি করেছেন, তারপর সব ছেড়ে বেছে নিয়েছিলেন আখড়ার জীবন। কুম্ভমেলায় এত সাধুসন্ন্যাসীর ভিড়েও ‘আইআইটি বাবা’ কেন সংবাদ মাধ্যমের বেশি নজরে পড়লেন এবং দেশব্যাপী রাতারাতি খ্যাতি অর্জন করলেন, তার কারণটি স্পষ্ট, সব সুখ হাতের নাগালে পাওয়ার পরও যিনি তা হেলায় ত্যাগ করতে পারেন, গুরুবাদী ভারতীয় সমাজে তার ত্যাগ ও কৃচ্ছসাধন একেবারে আগমার্কা খাঁটি বলে স্বীকৃতি পাবেই। ফেরারি বিক্রি করে সন্ন্যাসী হলে মিডিয়াতেও তাদের কদর আলাদা। আইআইটি বাবা’র জনপ্রিয়তা দেখে মনে হয়, অভয় সিংহকে একটা প্রতীক হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার সুচতুর প্রয়াস চলছে সমাজমাধ্যমের দক্ষিণপন্থী বাস্তুতন্ত্রে। সেই প্রতীক, যা বলছে যে, বিজ্ঞান মানুষকে জীবনের যে অর্থের সন্ধান দিতে পারে না, অধ্যাত্মবাদ সেটা পারে। অভয় সিংহ এমন একজন মানুষ, যিনি বিজ্ঞান না হোক, প্রযুক্তির উচ্চস্তরে শিক্ষা অর্জন করেছেন, সেই শিক্ষাকে পুঁজি করেছেন পেশাদারি জীবনে। তারপরও তিনি আধ্যাত্মিকতার কাছে আশ্রয় খুঁজলে তা কি বিজ্ঞানের সমূহ পরাভব নয়? কুম্ভমেলার পরিসরটিও তাৎপর্যপূর্ণ। সেখানে মুখ দিয়ে আগুন ছুড়ে, গায়ে ছাই মেখে, গলায় মড়ার খুলি দুলিয়ে, সস্তার বিভূতি দেখিয়ে তথাকথিত সন্ন্যাসীর দল খ্যাতি অর্জন করার চেষ্টা করে থাকেন। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পুণ্যার্থীদের সামনে, বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের উপর আধ্যাত্মিক ভাববাদের ধ্বজা ওড়াতে পারলে, হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রবল সুবিধা হয় রাজনৈতিক সমরাঙ্গনে। অভয় ধর্মব্যবসায়ী নন, তবুও বেচারা ধর্মব্যবসায়ীদের ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছেন।
কেউ অতি সচ্ছল মোহময় পেশাজীবনের হাতছানি ছেড়ে এসেছেন মানেই তিনি সন্ন্যাসমনস্ক, এই ধারণাটি নিতান্তই অতিসরলীকরণ। বহু মানুষ স্বেচ্ছায় অতি আকর্ষণীয় চাকরি ছেড়ে এসে মানব এবং সমাজকল্যাণে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজের জীবন, তাদের মধ্যে অনেকেই অধ্যাত্মবাদের ধারেকাছে যাননি, বরং সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন ভাববাদী দর্শনের বিপরীতে বস্তুবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে, প্রয়োজনে নিজের জীবন দিয়েই। চিকিৎসক থেকে মধ্যপ্রদেশের অবিসংবাদী শ্রমিক নেতা হয়ে ওঠা প্রয়াত শঙ্কর গুহনিয়োগী থেকে অধ্যাপক অলক সাগর, দৃষ্টান্ত কম নেই। আইআইটি দিল্লীর খ্যাতনামা অধ্যাপক, আমেরিকার হিউস্টন ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট করা মানুষ, রঘুরাম রাজনের মতো ব্যক্তিত্বের শিক্ষক, চাকরি থেকে পদত্যাগ করে মধ্যপ্রদেশের আদিবাসীদের উন্নতিকল্পে কাটিয়ে দিলেন সারাটা জীবন। এই অলক সাগর খালি গায়ে হেঁটে ধুতি পরে বেতুল জেলার কোচামুতে রোজ ষাট কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে দূরদূরান্তের গ্রামের গরিব আদিবাসীদের বীজশস্য সরবরাহ করে বেড়ান চাষের জন্য। আরেক উল্লেখযোগ্য নাম আনন্দ তেলতুম্বডে। ভারতের সেরা ম্যানেজমেন্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আহমেদাবাদের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট থেকে এমবিএ করে ভারত পেট্রোলিয়ামের এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর এবং আইআইটি খড়গপুরের খ্যাতনামা অধ্যাপক হয়েও সুখী নিশ্চিন্ত জীবনের মোহ ছেড়ে দক্ষিণপন্থা-বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জীবন কাটাচ্ছেন। অধ্যাপক সাগর বা অধ্যাপক তেলতুম্বডের, বৈভব ছেড়ে এসে জীবনের মানে খোঁজার জন্য আধ্যাত্মিকতার প্রয়োজন পড়েনি। এক ঝকঝকে মেধাবী আইআইটিয়ান যুবকের শেষ অবধি কুম্ভমেলায় গেরুয়া ও গঞ্জিকা সহযোগে আত্মানুসন্ধানের প্রক্রিয়ার প্রতি কৌতূহলী হওয়া যেতেই পারে, নানাবিধ ‘বাবা’র বাবা-মাহাত্ম্য সমাজমাধ্যমে বিপুল সাড়া ফেলতেই পারে, কিন্তু এই সব ঘটনাকে মহিমান্বিত করার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ নেই, এই সারসত্যটি যেন বিস্মৃত না হয়।