বামেদের বৃদ্ধতন্ত্র

এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

ভারতীয় রাজনীতির একটি গভীরতম অসুখের লক্ষণ হল, বার্ধক্য ছাড়া এ দেশে নেতৃত্ব হয় না।সব রাজনৈতিক দলেই তাই বুড়োদের জয়জয়কার চলছে। মুখে মুখে, দলীয় চিন্তন শিবিরে কিংবা পার্টির দলিলে সব রাজনৈতিক দলই সবুজের অভিযানের কথা দৃপ্তকন্ঠে উচ্চারণ করেন।কিন্তু এ দেশের মানুষ স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরেও কোনও রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে নবীন প্রজন্মকে দেখতে পাননি।ব্যতিক্রম যে একেবারে নেই,তেমনটাও নয়। ইন্দিরা গান্ধীর আকস্মিক দুঃখজনক মৃত্যুর পর রাজীব গান্ধীর হাতে দল ও সরকারের নেতৃত্ব যখন আসে,তখন বাস্তবিক অর্থেই দেশে ও সরকারের বিভিন্ন নেতৃত্বের প্রশ্নে তারুণ্যের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল।কিন্তু সেই যাত্রা ৫ বছরের বেশিকাল স্থায়ী হয়নি। ঠিক তেমনি বিজেপি দলেও অটল যুগের অবসানের মধ্য দিয়ে আদবানি, মুরলী মনোহর যোশীরা সবাই একে একে রাজনীতির পিছনের সারিতে চলে গেছেন।নরেন্দ্র মোদি দলে ও সরকারে তরুণদের বেশিমাত্রায় প্রাধান্য দিয়ে সামনে টেনে আনলেও ক্ষমতার লাগাম মূলত এক বা দুজনের হাতেই থাকায় নেতৃত্বে তরুণদের অংশগ্রহণের প্রক্রিয়াটি শুধুই টেবিলে সাজানো ফুলের তোড়ার মতোই শোভাবর্ধন করছে। কিন্তু সমস্যা হল, দেশের অন্য সব রাজনৈতিক দলগুলোকে স্বল্প পরিসরে হলেও তরুণ প্রজন্মকে সামনে টেনে আনার প্রক্রিয়া জারি থাকলেও দেশের অন্যতম আগমার্কা বিপ্লবী দল হিসাবে পরিচিত সিপিএম পার্টিতে এখনও পক্ককেশ নেতাদের দাপাদাপি বন্ধ হয়নি।যে দল কথায় কথায়, শ্লোগানে, ফেস্টুনে বিপ্লবের ধ্বজা উড়ায়,সেই দল কিছুতেই পার্টিতে তরুণ নেতৃত্বকে তুলে আনতে চায় না।অথচ প্রতিটি নির্বাচনের পরই দলীয় বিপর্যয়ের পর তরুণ প্রজন্মের হাতে দলীয় নেতৃত্ব তুলে দেওয়ার কথা বলেন।কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের উপস্থিতিতে রাজ্য নেতৃত্বের বৈঠকে পক্ককেশ নেতারা মাথা দুলিয়ে সকলেই সওয়াল করেন নতুন নেতৃত্বকে দলের সামনের সারিতে তুলে আনা দরকার। কেউবা বলেন, আমরা চাই নতুন নেতৃত্ব এবার উঠে আসুক। তারা নিজেদের কাঁধে দায়িত্ব তুলে নিক।পেছনে থেকে দলের প্রবীণ নেতৃত্ব নবীন প্রজন্মকে যথাসাধ্য সাহায্য সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দেন।কিন্তু তারপরও যে কি সেই।চেয়ার ও পদ আঁকড়ে থাকা নেতারা কোনওভাবেই চেয়ার থেকে সরতে চান না। ফলে সবুজের অভিযান কথার কথাই থেকে যায়।সম্প্রতি ত্রিপুরাতেও দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের উপস্থিতিতে সিপিএম রাজ্য কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।বরাবরের মতোই দেশে বামেদের আর পাঁচটা বৈঠকের মতোই এই বৈঠকেও রাজ্য নেতৃত্বে যুবাদের সামনে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পার্টি। কিন্তু লক্ষণীয় হল,এই বৈঠকে কেউই বলেননি কিংবা কোনও সিদ্ধান্ত ও হয়নি যে, তরুণদের সামনে জায়গা করে দিতে পুরানোরা চেয়ার ছেড়ে সরে দাঁড়াতে চান কিংবা ইস্তফা দিতে চান। ২০২৩ সালে ত্রিপুরা বিধানসভা নির্বাচনে বামেদের হতাশাজনক খারাপ ফলের পর এবারের যেমনটা রাজ্য কমিটির বৈঠক হয়েছে,তেমনি ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাওয়া সিপিএম ফল প্রকাশের পর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বৈঠকে বসেছিল। সেখানেও দেশে বাম বিপর্যয় নিয়ে সীতারাম ইয়েচুরি বলেছিলেন এই পরাজয়ের দায় আমার।পলিটব্যুরোও এই দায় স্বীকার করেছে। দল আরও বলেছিল, সিপিএম তাদের বক্তব্য মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করতে তুলতে পারেনি। তাৎপর্যপূর্ণ দিক হল,প্রতিটি নির্বাচনেই বিপর্যয়ের পর বাম নেতৃত্ব অনেক বাস্তবসম্মত কথ বললেও তাকে কখনও কার্যকরী করতে পারেনি। দল নবীন প্রজন্ম নেতৃত্বে নিয়ে আসার পক্ষপাতী হলেও সেটাকে বাস্তবায়িত করা দলের পক্ষেই সম্ভব হচ্ছে না। কারণ দলে পুরোমাত্রায় সক্রিয় পক্ককেশদের রাজ। গত নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে যেটা ঘটেছে, এবার ‘ত্রিপুরাতেও একই ঘটনা ঘটেছে। বিরোধী শক্তি হওয়ার বিশ্বাসযোগ্যতাও হারিয়েছে বামেরা। তবুও চেয়ার ও পদ আঁকড়ে থাকা নেতারা একচুলও সরে আসতে নারাজ।সারা দেশের নির্বাচক মণ্ডলীর কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর বামেরা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না।তিন রাজ্যের বাইরে লোকসভায় একটু আধটু প্রদীপ জ্বালিয়ে যতটুকু অস্তিত্বের জানান দিত পার্টি, আজ সেইটুকুও তাদের অবশিষ্ট নেই। কারণটা হল পক্ককেশ আর বয়সের ভারে ন্যুব্জ গোটা পাৰ্টিটাই আজ শয্যাশায়ী।নতুন রক্ত সংবহন ছাড়া মানব শরীর যেমন বাঁচতে পারে না, তেমনি তারুণ্যের ঢেউ আর যৌবন ছাড়া সংগঠন আন্দোলিত হতে পারে না। দলে ও সংগঠনে তরুণ রক্ত ছড়িয়ে দিতে না পারলে বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্রের সমস্যা ও মানুষের ভাবনা ও প্রত্যাশার মধ্যে মেলবন্ধন ঘটানো কখনোই সম্ভব হবে না।কিছু বিপ্লবী বামেদের দলের ভেতরকার গড়ে ওঠা শক্তপোক্ত বৃদ্ধতন্ত্র এই বাস্তবকে বুঝতে পারলেও তাকে ‘কোনওভাবেই কার্যকরী করতে দিচ্ছে না।তাই বামেদের রক্তরক্ষণ থেমে নেই।দেশের জনসংখ্যার দুই- তৃতীয়াংশের বয়স এই মহূর্তে ৪৫ বছর বয়সের নীচে। আর দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোতে, বিশেষ করে বামপন্থী দলের নেতৃত্বে ও পদাধিকারী পদে আসীন আছেন। অধিকাংশই ৫৫ ঊর্ধ্ব নেতারা। এই বিপরীতমুখী আহ্বান নিয়ে কোনও রাজনৈতিক দল বা সংগঠন ঘুরে দাঁড়াতে পারে না।ভাবের ঘরে চুরি করে ত্রিপুরার বাম নেতারা যদি এখন তরুণ নেতৃত্বকে সামনে না টেনে নিজেদের কর্তৃত্ব ও আধিপত্য বজায় রাখতে তরুণ প্রজন্মকে সাথে নিয়ে আন্দোলনে নেমে মানুষের আস্থা অর্জনের দাওয়াই খোঁজেন তাহলে ২০২৪-এর লোকসভা বা ২০২৮-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগেই চরম পরিণতির জন্য দল ও সংগঠনকে প্রস্তুত থাকতে হবে।

Dainik Digital

Share
Published by
Dainik Digital

Recent Posts

হৃদরোগে হঠাৎ মৃত্যু: কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের কারণ, লক্ষণ, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-বর্তমান যুগে হৃদরোগ জনিত সমস্যা ক্রমশ বেড়ে চলেছে।এর মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক ও জীবনঘাতী…

6 hours ago

প্রশ্নের মুখে বৈধ সীমান্ত বাণিজ্য, আমদানির তুলনায় রপ্তানি নামমাত্র, পরিস্থিতি চিন্তাজনক!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-বর্তমানে রাজ্যেনয়টি ল্যান্ড কাস্টম স্টেশন রয়েছে।কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই নয়টি ল্যান্ড কাস্টম স্টেশনকে…

7 hours ago

আঠাশের বিধানসভা নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধ থাকার বার্তা প্রদ্যোতের!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-২০২৮ সালে বিধানসভা নির্বাচনেও আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারলেই, আমাদের…

7 hours ago

হার্ভেকে নকআউট করে তপনের সেমিতে সংহতি!!

অনলাইন প্রতিনিধি:-তপন স্মৃতি নকআউট ক্রিকেটের দ্বিতীয় দল হিসাবে সেমিফাইনালে হার্ভেকে নকআউট করে তপনের সেমিতে সংহতি!!খেলার…

7 hours ago

সতর্কতাই বাঞ্ছনীয়!!

নজিরবিহীন গরমের মুখোমুখি রাজ্য। মার্চ মাসের শেষ দিকে গরমের এই প্রকোপ এককথায় নজিরবিহীন।এজন্য আবহাওয়া দপ্তরকে…

7 hours ago

খুশির ঈদ উদযাপন

অনলাইন প্রতিনিধি :-"ঈদুল ফিতর" যার অর্থ হলউপবাস ভাঙার আনন্দ। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় দুটো ধর্মীয় উৎসবের…

1 day ago