বার্ধক্যঃ জীবনের নতুন ইনিংস

 বার্ধক্যঃ জীবনের নতুন ইনিংস
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

বিভিন্ন কারণে জীবনে যে পরিবর্তনগুলি আসে , সেগুলো ঠেকানো সবসময় সম্ভবপর হয়ে ওঠে না । তবে এর জন্য যে মানসিক অবসাদের সম্ভাবনা দেখা দেয় , তা প্রতিরোধ করা যেতে পারে । তার জন্য প্রয়োজন কিছুটা জীবনশৈলীর পরিবর্তন । অবসরপ্রাপ্ত জীবনে কেউ যদি জীবনের কিছু নতুন উদ্দেশ্য এবং অবসর বিনোদনের স্বাস্থ্যকর উপায় খুঁজে পান তবে তা জীবনকে পুনরায় নতুন উদ্দমে বাঁচার খোড়াক দিতে পারে ।

এই প্রসঙ্গে উদাহরণস্বরূপ জাপানের শিগা প্রদেশের জীবনশৈলী যা ‘ শিগা রিদম ‘ নামে খ্যাত তা আলোচনা করা যাক । জাপানের উদাহরণ ভারতবর্ষের সঙ্গে সংস্কৃতিগত সাদৃশ্যের নিরিখেও প্রযোজ্য । কারণ আমাদের দেশের মতো তরুণ প্রজন্মের ওপরই বৃদ্ধ পিতা – মাতার যত্নআত্তি করার দায়িত্ব বর্তায় । কিন্তু বর্তমানে কয়েক দশক ধরে তরুণ সমাজ জীবিকার তাগিদে শহরমুখী হওয়ায় অপেক্ষাকৃত ছোট শহর এবং গ্রামীণ অঞ্চলের বদ্ধদের একাকীই নিজেদের বাস্তুভিটেতে রয়ে যেতে হয় । দেখা গেছে ২০০০ সনের আগে জাপানের ছোট্ট শহর এবং গ্রামাঞ্চলের ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের মধ্যে অবসাদের হার ছিল প্রায় ৩৩ শতাংশ , কিন্তু ২০২১ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৮-১২ শতাংশে ।

তাহলে কি এমন পরিবর্তন হল এই দুই দশকে ? জাপানের গড় যেমন বিশ্বে সর্বোচ্চ , তেমনি বার্ধক্যে অবসাদের হারও এখন বিশ্বে অন্যতম সর্বনিম্ন । পরিসংখ্যান অনুসারে , অবসাদগ্রস্তদের মধ্যে মৃত্যুর হারও সাধারণ জনগণের থেকে প্রায় চারগুণ বেশি জাপানের গড় আয়ু , বিশেষ করে শিগা প্রদেশের গড় আয়ু ৮২ বছর , যেখানে বিশ্বের গড় আয়ু ৭০ বছর । এমনকী শিগা প্রদেশে শর্তোদ্ধ ব্যক্তির সংখ্যা ও বিশ্বের তাবড় উন্নত দেশগুলির কাছে ঈর্ষাজনক । শিগাবাসীরা শুধু শারীরিক স্বাস্থ্য নয় , ভাল মানসিক স্বাস্থ্যেরও অধিকারী এবং এরাই প্রকৃতপক্ষে ‘ সুস্বাস্থ্য ’ শব্দটিকে সংজ্ঞায়িত করে ।

WHO- ও ‘ সুস্বাস্থ্য ’ – এর সংজ্ঞাতে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে । আমরা যদি শিগা প্রদেশের এই সুস্বাস্থ্যের কারণগুলো পর্যালোচনা করে দেখি , তবে দেখা যাবে যে , ওই অঞ্চলের অধিবাসীরা খুবই কম ধূমপান করেন , খেলাধূলো বেশি করেন এবং জনসেবামূলক কাজকর্মে নিজেদের নিয়োজিত রাখেন । জাপানি সংস্কৃতিতে ‘ ইকিগাই ’ শব্দটির খুব উল্লেখ পাওয়া যায় , যার অর্থ জীবনের সঠিক অর্থ খুঁজে পাওয়া । বলা বাহুল্য , শিগা নিবাসীরা এই ইকিগাই ধারণার খুব সদ্ব্যবহার করে থাকেন ।

ইদানীং বৈজ্ঞানিকেরা পাকতন্ত্রের সঙ্গে মস্তিষ্ক তথা মানসিক স্বাস্থ্যের একটি যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন । সোজা বাংলায় অনুবাদ করলে যা দাঁড়ায় , পেট ভাল তো মন ভাল । দেখা গেছে এদের খাদ্য তালিকায় ফার্মেন্টেড খাবার , জৈব পদ্ধতিতে চাষ করা , কীটনাশক মুক্ত ফল এবং সব্জির আধিক্য বেশি , যা কিনা অন্ত্রের উপকারী ব্যাক্টেরিয়ার বংশ বৃদ্ধির সহায়ক , যার ফলে এদের পাকতন্ত্রের গোলযোগ খুবই কম হয়ে থাকে এবং সুস্থ সবল দীর্ঘ জীবন পেতে সাহায্য করে । শুধু তাই নয় , এক্ষেত্রে প্রশাসনের ভূমিকাকে অবশ্যই সাধুবাদ দেওয়া উচিত ।

এই প্রদেশের গভর্নর তাইজো মিকাজুকি এই প্রাদেশিক জীবনশৈলীকে ‘ শিগা রিদম ‘ আখ্যা দিয়েছেন এবং সুস্থ , দীর্ঘ জীবনযাপনের মানোন্নয়ন ও একে উৎসাহিত করার জন্য আলাদা এক দপ্তর স্থাপন করেছেন । উদাহরণস্বরূপ এই দপ্তরটি , প্রদেশের বিওয়া হ্রদের তীর বরাবর ২০০ কিমি দৈর্ঘ্যের পরিসরে প্রায় ২০০ টির মতো স্বাস্থ্যকর জায়গা চিহ্নিত করেছে , যার মধ্যে বেশ কয়েকটি উষ্ণ প্রস্রবণও আছে এবং বিশ্রামের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা এবং ক্যাফেটেরিয়া নির্মাণ করেছে , উদ্দেশ্য এই দীর্ঘ পরিসরটিকে কাজে লাগিয়ে , নাগরিকদের ভ্রমণের জন্য উৎসাহিত করা এবং স্বাস্থ্যোন্নতি করানো ।

এমনকী এই হ্রদের তীরে অনেক ক্রীড়া বিনোদনের জায়গাও করে দেওয়া হয়েছে , যার অধিকাংশ খেলোয়াড়রাই হলেন অবসরপ্রাপ্তি নাগরিক । এছাড়াও প্রশাসনের উদ্যোগে শিগা বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্যান – পরিবেশবিদ্যার মতো দুই বছরের অনেকগুলো ডিপ্লোমা কোর্স খোলা হয়েছে , যাতে অবসরপ্রাপ্তরা তাদের জীবনের এই পর্বটার নতুন অর্থ খুঁজে উপভোগ করতে পারেন কিংবা কিছু অপূর্ণ শখগুলো এই নব্যলব্ধ বিদ্যার দ্বারা পূরণ করতে পারেন ।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে , শিগা প্রদেশের এই সুস্থ , দীর্ঘ জীবনের রহস্য হচ্ছে স্বাস্থ্যকর খাবার , পর্যাপ্ত শারীরিক শ্রম , সামাজিক কাজকর্ম এবং মহানগরীর ব্যস্ততাপূর্ণ জীবন , যা এক মানসিক চাপ সৃষ্টি করে , তার বিপরীতমুখী জীবনধারা । এই ধরনের জীবনশৈলী যদি অনুকরণ করা যায় , তবে বার্ধক্যে অবসাদ প্রতিরোধের পাশাপাশি , দীর্ঘায়ুও হওয়া যায় এবং জীবনের এই নতুন ইনিংসটিকে পূর্ণ রূপে উপভোগ করা যায় ।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.