বার্ধক্য এবং মানসিক অবসাদ
এই মাত্র অবসর নিলেন কর্মজীবন থেকে , সবকিছু গুছিয়ে আনা হয়েছে কিন্তু তাও জীবনে কেমন যেন শূন্যতা নেমে এসেছে এবং বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা যেন ক্রমশ বেড়েই চলছে । জীবনের অভীষ্ট তো সব কিছুই পাওয়া গেল কিন্তু তবুও কেমন যেন মনে আর আনন্দ বোধ হয় না । আড্ডা মারতে একেক সময় একদম ভাল লাগে না, কোনও সময় তুচ্ছ বিষয়ে ও খুব বিরক্তি বোধ এসে যাচ্ছে । মন – মেজাজও আজকাল আর খুব একটা ভাল থাকে না , অনেক সময় খিটখিটেও লাগে । সব বিষয়ে নিরুৎসাহিত বাড়ছে এবং আত্মবিশ্বাসও কমছে , কেমন যেন নিজেকে খুব অসহায় বোধ হয় । শরীরের সামর্থ্য এবং শক্তি বয়সের প্রেক্ষিতে অনেকটাই কম মনে হয়।ঘুমের ব্যাঘাত প্রায়শই হচ্ছে এবংঅনেকক্ষণ শুয়ে থাকার পরও বিছানা ছাড়তে আর ইচ্ছে করে না , মনে হয় । যেন ঘুমটা পুরোই হয়নি । খাওয়া দাওয়াতেও তেমন একটা রুচিবোধ হয় না । এই সমস্ত অসুবিধাগুলি অনেকদিন ধরে চললেও নিজের এবং পরিবারের লোকের মনে হয় , এটাই তো স্বাভাবিক । বয়স বাড়লে তো এমন একটু আধটু হবেই , সময়ের সঙ্গে নিশ্চয়ই ঠিক হয়ে যাবে । আমি ঠিক এই জায়গাটাতেই এবার একটু থামতে চাই এবং সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই । উপরিউক্ত যে উপসর্গগুলি নিয়ে এতক্ষণ আলোচনা করলাম , সেগুলো হল বয়সজনিত অবসাদ । পরিসংখ্যান বলছে , ভারতবর্ষে এর সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে এবং বিভিন্ন পৃথক সংস্থার তথ্য অনুযায়ী তা প্রায় ২৫-৩৫ শতাংশ যেখানে গোটা বিশ্বে এই জেরিয়াট্রিক ডিপ্রেশনের হার ৪-১৬ শতাংশ ।
শুধু তাই নয় দেখা গেছে জেরিয়াট্রিক ডিপ্রেশনে আক্রান্তদের মৃত্যুর হারও প্রায় চার গুণ বেশি । ডিপ্রেশনের সঙ্গে হৃদরোগের একটা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক রয়েছে , সেই সঙ্গে রক্তচাপজনিত সমস্যা ডায়বেটিস , পেটের সমস্যা , আর্থ্রাইটিস প্রভৃতি রোগের প্রাদুর্ভাব কিংবা তীব্রতা বৃদ্ধি হয়ে থাকে । বয়স্কদের ক্ষেত্রে ডিপ্রেশনের নানাবিধ কারণ থাকতে পারে । অবসর নেওয়ার পর যেমন অর্থক্ষমতা সংকুচিত হয় , তেমনি বয়সের সঙ্গে প্রকৃতির নিয়মে কিছুটা শারীরিক ক্ষমতাও হ্রাস পায় , সেই সঙ্গে দেখা দেয় নানাবিধ শারীরিক ব্যাধি , যা প্রত্যক্ষভাবে আরও সক্ষমতা কমায় । নগরায়ণের ফলে এখন যুবসমাজ শহরমুখী বিশেষত গ্রামাঞ্চল কিংবা ছোট শহরগুলির মধ্যে যেখানে জীবিকা অর্জনের মাধ্যম ক্রমশই সংকুচিত হচ্ছে , সেখানে শহরমুখী হওয়া ছাড়া কোনও গত্যন্তরও থাকে না । এরফলে হয় পুরোনো বাসস্থানে রয়ে যাচ্ছেন অভিভাবকরা কিংবা কোনও কোনও ক্ষেত্রে নতুন শহরে , নতুন পরিবেশে গিয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন ।বয়স যখন বাড়তে থাকে , তখন পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটাও কঠিন হতে থাকে । ইন্টিলিজেন্স থিওরি অথবা বুদ্ধিমত্তা বিকাশের আধুনিক প্রবক্তারা মনে করেন বয়সের সঙ্গে সম্পূর্ণ নতুন জিনিস শেখার ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে , যার জন্য বয়সের সঙ্গে মানুষ কিছুটা পরিবর্তন বিমুখ হতে থাকে , আর এই পরিবর্তন যদি বড়মাপের হয় , যেমন দীর্ঘ পরিচিত বাসস্থান , পরিবর্তন কিংবা ছেলে – মেয়েদের কর্মসূত্রে দূরত্বে অবস্থান , তখন এই পরিবর্তন মানিয়ে নেওয়া অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়ায় যা মনের মধ্যে একটা চাপের সৃষ্টি করে । অবসরের পর নবীনের কাছে দায়িত্ব ও ক্ষমতা হস্তান্তর এবং নিজেকে গুটিয়ে ফেলার মধ্যে ধীরে ধীরে এক গুরুত্বহীন হয়ে পড়ারমনোভাব গ্রাস করতে থাকে । বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমবয়সস্কদের মৃত্যু সংবাদ একটা একাকীত্বের সৃষ্টি করে । এইসব কারণ ছাড়াও রয়েছে বৃদ্ধদের প্রতি অবহেলা এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে মানসিক এবং শারীরিক নিগ্রহ । সুতরাং দেখা যাচ্ছে স্বাভাবিক কারণেই বার্ধক্যে ডিপ্রেশন হবার আশঙ্কা অনেকটাই বেশি থাকে । আমাদের সমাজ ব্যবস্থার সমস্যাটা হল মানসিক ব্যাধির প্রতি অবহেলা এবং আক্রান্তদের অবজ্ঞা প্রদর্শনও তুচ্ছ , তাচ্ছিল্য করা । মানসিক সুস্থতা এখানে মানসিক দুর্বলতার নামান্তর । তাই মানসিক অসুস্থতা থাকলে রোগী একে চেপে যাওয়াই শ্রেয় বলে মনে করেন লোক লজ্জার ভয়ে । কিন্তু এই ডিপ্রেশনের জন্য বর্তমানে ভাল চিকিৎসা রয়েছে এবং সঠিক চিকিৎসা হলে দেখা গেছে রোগমুক্তির সঙ্গে জীবনের মান এবং আয়ু দুই বিস্তারিত হয় । কারণ দেখা গেছে , ডিপ্রেশনের সুচিকিৎসা হলে ব্লাড প্রেসার – সুগার ইত্যাদিও নিয়ন্ত্রণে থাকে । তাই বার্ধক্যে ডিপ্রেশন হলে , উপরিউক্ত উপসর্গগুলি দেখা দিলে , আর কাল বিলম্ব না করে , কোনও মনোরোগ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন ফিরে পান ।