বিচারের বাণী
নিঠারি কান্ড। সতেরো বছর আগে নয়ডার সেক্টর ৩১-এর ডি ৫ বাড়িটির অন্দরে হাড় হিম করা ঘটনার কথা সামনে এলে শিউরে উঠেছিল গোটা দেশ। উনিশ জন বালিকা, কিশোরী ও তরুণীকে নৃশংসভাবে যৌন নির্যাতন করে খুন, পাশের নর্দমা থেে বহু নরকাল ও হাড়গোড় উদ্ধার, প্রেসার কুকারে সেদ্ধ করে ধৃতদের বিরুদ্ধে নরমাংস ভক্ষণের অভিযোগ। উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদের নিম্ন আদালত এই ঘটনাকে বিরলতম অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করে ধৃত দুই অভিযুক্ত যথাক্রমে ওই বাড়ির মালিক মনিন্দর সিং পান্ধের এবং তার পরিচারক সুরেন্দ্র কোলিকে সর্বোচ্চ সাজা দিলেও সোমবার তাদের অপরাধ লঘু বলে বিবেচিত হল এলাহাবাদ হাইকোর্টে। দুইজনেরই ফাঁসির সাজা রদ হলো। সুরেন্দ্রের সাজা বদলে গেলো যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে, আর মনিন্দরকে বেকসুর মুক্তি দিল উচ্চ আদালত। যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ না থাকায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বিচারপতি অশ্বিনী কুমার মিশ্র ও বিচারপতি সৈয়দ আফতাব হুসেন রিজভির বেঞ্চ। বিচারপতিদ্বয় সুরেন্দ্রর বিরুদ্ধে বারোটি মামলা এবং পান্ধেরের দুটি মামলা খারিজ করে দিয়েছেন। অথচ নিম্ন আদালতে দুই জনের ফাঁসির সাজা হয়েছিল। নিঠারি কাণ্ডে মোট উনিশটি মামলার মধ্যে ৬ টি মামলা ছিল মনিন্দরের বিরুদ্ধে, যার মধ্যে তিনটি মামলা প্রমাণাভাবে আগেই বন্ধ করে দেয় সিবিআই।
সোমবার উচ্চ আদালতে রায়ের পরে মোট ৬ টি মামলাতেই খালাস পেল মনিন্দর। ফলে,তার মুক্তি এখন সময়ের অপেক্ষা। যদিও এই মামলায় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই এবং সরকারী আইনজীবীর ভূমিকায় অসন্তোষ প্রকাশ করে ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়েছে, জনগণে আস্থার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে।ঘটনাচক্রে, পশ্চিমবঙ্গের কামদুনি গ্রামে ধর্ষণ করে খুনের মামলাতেও নিম্ন আদালতের দেওয়া ফাঁসির সাজা সম্প্রতি রদ হয়েছে কলকাতা হাইকোর্টে। সেই রায় আসা ইস্তক সমাজের নানা স্তরে তীব্র প্রতিক্রিয়া চলছে। নিঠারি মামলার এই অন্তঃসারশূন্য পরিণতিকেও কামদুনি মামলার পুনরাবৃত্তি বলা যেতেই পারে। এলাহাবাদ উচ্চ আদালতের এই রায়ের পর প্রশ্ন উঠে শিশুধর্ষণ, নৃশংসভাবে শিশুদের হত্যা, তথ্য লোপাট, এমনকী নরমাংস ভক্ষণের কথা সুরেন্দ্র যখন জেরায় স্বীকার করেছিল, কবুল করেছিল নিজের দোষ, তবু তাদের দোষ প্রমাণ করা গেল না কেন? যদিও আদালতের বক্তব্য, প্রমাণ সংগ্রহের যে নিয়ম রয়েছে, তদন্তকারী সংস্থা তা লঙ্ঘন করেছে। এই রায়ের পরে নিহতের পরিজন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের কাছে মনিন্দর ও সুরেন্দ্রর ফাঁসির আবেদন জানিয়েছেন। মোদ্দাকথা, গোটা ঘটনায় সিবিআই তদন্তের ধরন, পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা এবং আদালতে সরকার নিযুক্ত আইনজীবীদের অকর্মণ্যতা দিনের শেষে নাগরিকসমাজকে উদ্বিগ্ন ও হতাশ করেছে দণ্ডের অভিঘাত লঘু করতে গিয়ে স্বয়ং বিচারপতিদ্বয় তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে মন্তব্য করেছেন, ‘সন্দেহের ঊর্ধ্বে উঠে দুই অভিযুক্তকে দোষী প্রমাণিত করতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থা, এটা অত্যন্ত হতাশজনক। দায়িত্বশীল তদন্তকারী সংস্থা হিসাবে তারা মানুষের বিশ্বাসের সঙ্গে চরম প্রবঞ্চনা করেছে।
২০০৬ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশ্যে আসা এই ঘটনা দেশে শিশু, -বালক-বালিকা হিংসার প্রচণ্ডতাকে প্রকট করেছিল। প্রকট করেছিল। একুশ শতকের ভারতেও দরিদ্র ঘরের অভাবি শিশুদের নিরাপত্তার অভাব। রাজনৈতিক প্রশ্রয়প্রাপ্ত, মতান্তরে ধর্ষণকামী দুষ্কৃতীদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে উন্মত্ত অত্যাচার কোন পর্যায়ে পৌঁছতে পারে, নিঠারি তার নিদর্শন।এই প্রেক্ষাপটে এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। রায়ের পর বিচারবিভাগের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেও দুশ্চিন্তার কথাি উপস্থাপন করতেই হয় – অপরাধের গুরুত্ব কেন প্রতিষ্ঠা করা গেল না? নিরীতে নির্ভয়া কাণ্ডে অপরাধের গুরুত্ব আদালতে স্বীকৃত হল কঠোরতম সাজাও মিলল অভিযুক্তদের, অথচ নির্বারি কাজে কেন লঘু হল দণ্ড? কী করে বেকসুর ছাড়া পাবে নিম্ন আদালতে ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত এক আসামি? কেন এই অপরাধকে অধিক গুরুত্বে মণ্ডি করা গেল না?
এলাহাবাদ হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের রায় বলেছে, নিঠারি কাজে দুই অভিযুক্ত বিরলতম অপরাধ সংঘটিত করলেও তা প্রমাণে সরকার ব্যর্থ। কেন এই ব্যর্থতা, সেই প্রশ্ন অত্যন্ত সঙ্গত। এই মামলার রায় আইন-শাসন নিয়ে উদ্বেগকে তীব্র করে দিয়ে গেল তো বটেই, স্পষ্ট হল, বিচারের বাণী আজও নীরবে নিভৃতে কাঁদে।