বিতর্কের সুবর্ণজয়ন্তী

 বিতর্কের সুবর্ণজয়ন্তী
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

লিপিহীনতা কোনও একটি ভাষিক গোষ্ঠীর জীবনে যেন অর্থহীন শব্দোচ্চারণ ছাড়া আর কিছুই নহে। মানুষের ভাষা আছে কিন্তু লিপি নাই,এমন ভাষার বিকাশ কোনও দিন সম্ভব নহে। আমাদের দেশে স্বাধীনতার এতকাল পরেও মোট জনসংখ্যার একটি বৃহৎ অংশের জীবনে এই ঘটনা ঘটিয়া চলিয়াছে। সেইসব ভাষিক গোষ্ঠী তাহাদের লিপি উদ্ধারে বা নির্মাণে সচেষ্ট থাকিলেও অনেক ক্ষেত্রেই তাহার অগ্রগতি নাই। উদাহরণ খুঁজিতে অধিক দূরত্বে যাওয়ার প্রয়োজন নাই। এই রাজ্যে ককবরকভাষীদের কথাই সর্বাগ্রে বলা যায় এই প্রসঙ্গে।তাহাদের লিপি কী হইবে উহা লইয়া কাটিয়া যাইতেছে প্রায় পাঁচ দশকের বেশি সময়।

ভাষার বিকাশ কিংবা ছাত্রদিগের পড়াশোনায় ককবরক ভাষার কথা স্বীকৃত থাকিলেও সেই ভাষার কোনও লিপি নাই। সরকারের ঘরে ককবরকের উন্নতি লইয়া বিকট বিশাল কথা উচ্চারিত হইতেছে সভায়, সেমিনারে। ইহার বাইরে আর কিছু দেখা যাইতেছে না কোথাও। বলা হইয়া থাকে মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ। কথাখানা যে অতীব সত্য তাহাতে কাহারও কোনও সন্দেহ থাকিবার অবকাশ নাই। ভাষার ভাবাবেগ লইয়া একখানি দেশ জন্ম লইল।বাঙ্গলাদেশ।এই বাঙ্গলাভাষীদিগের সহনাগরিকের ভাষা ককবরক আজ ত্রিপুরায় প্রশাসনিক রসিকতার শিকার। এই রসিকতা চলিতেছে এই ভাষাকে রাজ্যভাষা স্বীকৃতি দিবার অনেককাল আগে হইতেই।

কালে কালে রসিকতার রূপ কিংবা স্বরূপ বদলাইতেছে মাত্র। আর কিছুই হইতেছে না। সকলেই জানে, কোনও ভাষার লিপি কীরূপ হইবে তাহা বলিবেন সেই ভাষায় কথা বলেন যাহারা, অর্থাৎ এই ভাষা যাহাদের মাতৃভাষা,তাহারাই সেই ভাষার লিপি, শব্দরূপ, ভাষার প্রমিতকরণের অধিকারী।তাহাদের মধ্যে এই ভাষা লইয়া যে আবেগ এবং ভালোবাসা কাজ করিবে তাহা অন্য কাহারও মধ্যে থাকিবে না।ককবরকের লিখিত রূপের যাত্রালগ্নে লিপি বাঙ্গলায় হইবে কি রোমানে -এই লইয়া এক বিতর্ক শুরু হইয়াছিল। এই বিতর্ক তিন-তিনটি ভাষা কমিশন গড়াইয়া আজ হইতে আড়াই দশক আগে নীরব হইয়াছিল পবিত্র সরকার কমিশনের সুপারিশক্রমে।

সংখ্যাগরিষ্ঠ ককবরকভাষীর অভিমতক্রমে রোমান হরফের কথাই মানিয়া লওয়া হয়। কিন্তু এই অবধি আসিয়া করবরক ভাষাকে আগাইয়া নিতে বেসরকারী পর্যায়ে যাহা যাহা করার প্রয়োজন সকলই হইলেও সরকারীস্তরে আর তেমন অগ্রগতি দেখা গেল না।বরং কিছু কিছু স্থানে বিপত্তি দেখা দিল, যাহা এই ভাষার অগ্রগমনকে রুদ্ধ করিয়া আবারও চার পাঁচ দশক পিছনে লইয়া যাইতে চাহিতেছে।এইরকম এক প্রেক্ষাপটে দাঁড়াইয়া ককবরক ভাষার লিপি আন্দোলনের পথিকৃৎ সংগঠন ককবরক সাহিত্য সভা তাহাদের সুবর্ণ জয়ন্তী বর্ষ উদযাপন করিতে যাইতেছে। এই মাসের ৯,১০,১১ তারিখে নানান অনুষ্ঠানে সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন হইবে।

বলা দরকার, এই সাহিত্য সভা জন্মলগ্ন হইতেই ককবরকের অগ্রগমনে রোমান লিপি চাহিয়া আসিতেছে। অর্থাৎ, এই সংগঠনের জন্ম আর ককবরকের লিপি বিতর্কের বয়স এক এই কথাও বলা যাইতে পারে। এই পঞ্চাশতম বর্ষে ককবরক কোন্ জায়গায় দাঁড়াইয়া আছে ইহার আভাস লওয়া দরকার। সিবিএসসি, আইসিএসসি কারিকুলামে ককবরক স্বীকৃতি পাইয়াছে। এই ভাষার সকলের মনে অন্য আশা জাগিয়াছিল এইবার বুঝি বাধার অর্গল খুলিয়া যাইতেছে। কিন্তু তাহা হইল না।এইখানেও ককবরক লিপি বাঙ্গলায় লিখিতে হইতেছে। ছাত্রদের অনীহা, অনিচ্ছা শোনা হইতেছে না। ত্রিপুরা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ককবরক পড়ানো হইতেছে, গবেষণা করিবার সুযোগও তৈরি হইতেছে, কিন্তু লিপি বিতর্ক এখনও শেষ হয় নাই।

১৯৭৯ সালে ককবরক ত্রিপুরার অন্যতম রাজ্যভাষা বলিয়া ঘোষণা হইয়াছিল। এরপর ভাষার বিকাশে যাহা করা দরকার সেইগুলি নিরবচ্ছিন্নভাবে করা যায় নাই। মাঝেমাঝেই ককবরকভাষীদের ভাষার প্রতি আবেগ ও ভালোবাসা রাজনীতিকদের তৃণীরের বাণ হিসাবে কাজে লাগিয়ছিল নানান ভোটের সময়ে। ২০২৩ সালের বিধানসভার ভোটের বাকি আর মাত্র দেড়-দুই মাস। এই সময়ে ককবরকের লিপি অসন্তোষ পাহাড়ে বা সমতলের ককবরকভাষী মানুষের জীবনে নতুন করিয়া ভোটের ইস্যুসর্বস্বতা হইয়া সামনে না চলিয়া আসে।

তবে সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবের প্রাক্কালে ককবরক সাহিত্য সভা জানাইতেছে, ককবরকের লিপি লইয়া আরেক ধরনের ষড়যন্ত্র চলিতেছে।সেই সকল বিষয়সকলই তাহাদের সম্মুখে আসিয়া পড়িয়াছে। শিক্ষাঙ্গনে একশ্রেণীর লোক যেমন করবরকে বাঙ্গলা লিপি চাপাইয়া দিবার চেষ্টা চালাইয়া যাইতেছে আবার রাজনীতিতেও একশ্রেণীর লোকজন ককবরকে দেবনাগরী লিপি চাপাইয়া দিবার প্রচেষ্টা লইয়াছে। আড়াই তিন দশক রাজনীতিতে রোমান বনাম বাঙ্গলার লড়াই চলিয়াছিল। সেই বিতর্ক থামিবার পর এইবার আবার রোমান বনাম দেবনাগরীর বিতর্ক শুরু হইলে এই ভাষার বিকাশ যে ফের পাঁচ দশক পশ্চাতেই ফিরিয়া যাইবে তাহাতে আর সন্দেহ কী!

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.