বিদায় ১০৩২৩!!
চিরনিদ্রায় শায়িত হলো ১০৩২৩।সাম্প্রতিক ত্রিপুরা হাইকোর্টের একটি রায়ে ১০৩২৩ মামলার যবনিকাপাত হলো। আপাতত বলা যায় ১০৩২৩-র জন্য সব দরজাই বন্ধ হয়ে গেলো। ১০৩২৩ মানে ২০১০ সালের শিক্ষা দপ্তরে নিয়োগপ্রাপ্ত গ্র্যাজুয়েট টিচার,২০১১ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত পোস্ট গ্র্যাজুয়েট টিচার এবং ২০১৪ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত আন্ডার গ্র্যাজুয়েট টিচার। মিলিয়ে সংখ্যাটা ১০৩২৩।যদিও এই সংখ্যা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। সে যাই হোক,১০৩২৩ এই রাজ্যে একটি বহুল চর্চিত সংখ্যা।
২০১৪ সালের মে মাসে ত্রিপুরা হাইকোর্ট সর্বপ্রথম এই মামলায় তিনটি ক্যাটাগরির শিক্ষক নিয়োগ যথোপযুক্ত হয়নি বলে রায়ে জানায়।এরপর হাইকোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্ট, দফায় দফায় মামলা মোকদ্দমা শেষে শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ দুই বার বাড়ে অ্যাডহক ভিত্তিতে। শেষ পর্যন্ত কোভিড চলাকালীন সময়ে ২০২০ সালের ৩১ মার্চ ১০৩২৩ শিক্ষকের চাকরি চিরতরে শেষ হয়ে যায়। অবশেষে ১০৩২৩ শিক্ষকের কফিনে শেষ পেরেকটি বসে গত মঙ্গলবার,২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩।সব দরজাই শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেলো। বলা যায় তাদের জন্য।প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক,তাদের অর্থাৎ শিক্ষকদের দোষ কোথায় ? শিক্ষকরা কি রাষ্ট্রের পরিচালনাগত ত্রুটির শিকার নয় ? হাইকোর্ট কিংবা সুপ্রিম কোর্ট তথ্যের, নথির উপর ভিত্তি করে নিয়োগ নিয়ে শুধু মন্তব্য করেছে এবং রায় দিয়েছে। কিন্তু আদতে ১০৩২৩-এর আজকের এই পরিণতির জন্য দায়ী কারা ?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আরও পেছন ফিরে দেখতে হবে। সুদীর্ঘ বাম আমলে ২০০২, ২০০৬ এবং ২০০৯ সালে শিক্ষা দপ্তরে শূন্যপদের ভিত্তিতে যে বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিলো এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম ২০১০ সালের মার্চ/এপ্রিল মাসে গ্র্যাজুয়েট টিচার পদে নিয়োগপত্র ছাড়া হয়, ২০১১ সালে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট পদে নিয়োগপত্র ছাড়া হয় এবং ২০১৪ সালে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট পদে নিয়োগপত্র ছাড়া হয়।ততদিনে দেশে শিক্ষার অধিকার আইন লাগু হয়ে যায় এবং প্রথম বলি হয় ১০৩২৩ শিক্ষক।বাম আমলে চাকরি পাবার প্রথম এবং একমাত্র যোগ্যতা ছিল পার্টি করা।পার্টির পেছনে হাঁটা, নেতার বাড়ি গিয়ে অর্থাৎ লোক্যাল কমিটির নেতার বাড়ি গিয়ে চাকরির জন্য লিস্টে নামটা ওঠিয়ে নিতে পারলেই চাকরি সুনিশ্চিত। সুদীর্ঘকাল ধরে এটাই হয়ে আসছিল। ২০০২, ২০০৬ এবং ২০০৯ সালের বিজ্ঞাপনমূলে শিক্ষকের চাকরিগুলি ছাড়া হয় ২০১০ সালে শিক্ষার অধিকার আইন লাগুর পর। যথারীতি চাকরি নিয়ে অনেক অভিযোগের পর মামলার পরিপ্রেক্ষিতেই আজকের এই পরিণতি। দ্বিতীয়ত, ১০৩২৩ শিক্ষক রাজনীতিরও শিকার।বাম আমলে ২০১৪ সালে তাদের চাকরি চলে যাবার পর সুপ্রিম কোর্টে স্পেশাল লিড পিটিশন দাখিল করেও কোনও কাজের কাজ হয়নি। হাইকোর্টের রায়ই বহাল থাকে। তবে শিক্ষকের অভাবের জন্য কিছুদিন অ্যাডহক হিসাবে তাদের রেখে দেবার একটা সুযোগ করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট। এর মধ্যে চলে আসে ২০১৮ সাল। রাজ্যে বামফ্রন্টবিরোধী হাওয়া তখন তুঙ্গে। ১০৩২৩ চাকরিহারাদের ইস্যুটি লুফে নেয় সেসময়কার বিরোধী বিজেপি।২০১৮ সালের নির্বাচনে ১০৩২৩ ইস্যু ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু। বিজেপি এটিকে হাতিয়ার করে নির্বাচনে ব্যাপক প্রচারও করে। এমনকী বিজেপির ভিশন ডকুমেন্টেও এই ইস্যুটি রাখা হয়। কিন্তু ২০১৮ সালে ক্ষমতায় এসে প্রথম বিজেপি জোট সরকার একপ্রকার ১০৩২৩ ইস্যুটিকে ভুলেই যায়। ১০৩২৩ শিক্ষকরা দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুললেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বরং বিজেপি ১০৩২৩ সংগঠনকে তিনটি টুকরোয় পরিণত করতে সফল হয়। অবশেষে ২০২০ সালে করোনাকালে ১০৩২৩-এর শিক্ষকদের এককালীন ৩৫ হাজার টাকা করে দিয়ে বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। ফের চলে আসে ২০২৩ সালের নির্বাচন। জানুয়ারী মাসে হঠাৎই রাজ্য সরকার ঘোষণা করে যে, ১০৩২৩ শিক্ষকদের বিষয়ে সরকার একটি কমিটি গঠন করবে। সেই কমিটি ৩১শে মার্চের মধ্যে তাদের রিপোর্ট পেশ করবে। আদতে কমিটি তিন সদস্যের হলেও একজন সদস্য আগেভাগেই জানিয়ে দেন যে তিনি এই টিমে থাকবেন না। এবং শেষ পর্যন্ত দুইসদস্যক কমিটি।৩১ মার্চের আগেই তাদের রিপোর্ট রাজ্য সরকারের কাছে পেশ করে এবং কমিটির রিপোর্ট ১০৩২৩ -এর পক্ষেই সুপারিশ করে বলে জানা গেছিল।এরই মধ্যে ফের একটি মামলা হয় হাইকোর্টে। অবশেষে সেই মামলারও সলিলসমাধি ঘটে গত ২৬শে সেপ্টেম্বর। অর্থাৎ ১০৩২৩ এখন ক্লোজড চ্যাপ্টার। উল্টো মামলাকারীকে জরিমানা করা হয় আদালতের সময় নষ্টের জন্য। এবার প্রশ্ন করা যায় রাজ্য সরকারের কাছে কমিটির রায়ের কী হলো?তা সর্বসমক্ষে আনা হচ্ছে না কেন? ভোটের মুখে কেন তাহলে কমিটি গঠন করা হয়েছিলো? সবটাই কি লোকদেখানো ছিল? ১০৩২৩ শিক্ষকদের ললিপপ দেখানো হয়েছিলো ভোটের মুখে? তাহলে বলাই যায় ১০৩২৩ শিক্ষক এ রাজ্যে রাজনৈতিক কারবারিদের ষড়যন্ত্রের শিকার— যা এ রাজ্যের বুকে ইতিহাসে স্থান করে নেবে।