বিদ্যাজ্যোতির ভবিষ্যৎ!

 বিদ্যাজ্যোতির ভবিষ্যৎ!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

ত্রিপুরার বিদ্যাজ্যোতি স্কুলগুলির মাধ্যমিক এবং দ্বাদশের রেজাল্ট নিয়ে একেবারে হৈ চৈ পড়ে গিয়েছে। কেননা বিদ্যাজ্যেতি স্কুলগুলির ছাত্রছাত্রীদের মাধ্যমিক এবং দ্বাদশের ফল মোটেও সন্তোষজনক হয়নি। উভয় পরীক্ষাতেই প্রায় ৪০%-৪৫% ছেলেমেয়ে ফেল করেছে। বিদ্যাজ্যোতি স্কুলগুলি সিবিএসই পরিচালিত। সিবিএসই’র স্কুলগুলিতে এত সংখ্যক ছাত্রছাত্রীর অকৃতকার্য হওয়া সত্যিই নজিরবিহীন। সিবিএসই সম্পর্কে সাধারণ্যে একটা সম্যক ধারণা রয়েছে যে সাধারণ এবং অতি সাধারণ মানের ছাত্রছাত্রীরাও এই বোর্ডে ৬০-৭০% নম্বর স্কোর করতে পারে। তাহলে সিবিএসইর বিদ্যাজ্যোতি স্কুলগুলি রাজ্যে এত হতাশাজনক পারফরমেন্স করল কেন? যথারীতি ছাত্রছাত্রীদের অকৃতকার্যের দায় শিক্ষক শিক্ষিকাদের ঘাড়ে চাপানো হয়েছে। শিক্ষক শিক্ষিকাদের দায় হয়তো রয়েছে, কিন্তু সবটা নয়। প্রশাসনিক ব্যর্থতা মূলত এর জন্য দায়ী। পরিকাঠামোগত ব্যর্থতাও এর জন্য দায়ী। তড়িঘড়ি বিদ্যাজ্যোতি স্কুলের নামে ছাত্রছাত্রীদের সিবিএসইতে ট্রান্সফর্ম করার বিষয়টিও রয়েছে। সর্বোপরি বিদ্যাজ্যোতি স্কুলের শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব ছিল। শুধু প্রশিক্ষণের অভাব বললে কম হবে, বিদ্যাজ্যোতি স্কুলগুলির শিক্ষকদের কয়জন ইংরেজি মাধ্যমে পড়াতে পারেন তার আগে একটু খোঁজ নেওয়া দরকার ছিল দপ্তরের। এছাড়াও সিবিএসই’র প্যাটার্ন সম্পর্কে এদের ধারণা দেওয়া হয়েছিল কি? প্রাথমিকভাবেই একশটি স্কুল কেন খোলা হয়েছিল? কেন পরীক্ষামূলকভাবে ২৫টি স্কুল বিদ্যাজ্যোতিতে কনভার্ট করা হল না? এটা কি ছাত্রছাত্রীদের সাথে রসিকতা করেনি রাজ্য সরকার? ২০২১ সালে রাজ্যের ১০০টি স্কুলকে বিদ্যাজ্যোতিতে রূপান্তরিত করা হয়েছিলো। সেসময় গালভরা যেসমস্ত কথা বলা হয়েছিলো বিদ্যাজ্যোতি সম্পর্কে হেন্ করেঙ্গা, তেন্ করেঙ্গা। কিন্তু প্রথমবারের মতো ফলাফলে কী দাঁড়াল? সেসময়ে বিদ্যাজ্যোতি স্কুল, সিবিএসইতে রাজ্যের স্কুলগুলিকে রূপান্তরিত করার জন্য সবচেয়ে বেশি উৎসাহী ছিলেন তদানীন্তন শিক্ষাসচিব সৌম্যা গুপ্তা। ছিলেন তদানীন্তন শিক্ষামন্ত্রীও। তাদের অতিউৎসাহে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই শিক্ষা দপ্তরে একের পর এক প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। শিক্ষক নেই, ক্লার্ক নেই। পরিকাঠামো নেই, কিন্তু প্রকল্প ঘোষণা হচ্ছিল একের পর এক। ফলে শিক্ষা দপ্তরের উপর মারাত্মক চাপ এসে পড়ে। প্রকৃতির নিয়মমতো জল যেমন নিচের দিকে গড়ায়, তেমনি সমস্ত চাপ এসে পড়ে শিক্ষকদের উপর। হাঁপিয়ে উঠতে থাকেন শিক্ষকরা। একদিকে ১০৩২৩ জন শিক্ষকের ঘাটতি, অপরদিকে টেটের মাধ্যমেও শিক্ষক ঘাটতি পূরণে সরকারের গড়িমসি- সব মিলিয়ে শিক্ষা দপ্তরে এক
অভূতপূর্ব অরাজকতা চলতে থাকে। এর উপর একের পর এক প্রকল্প চালু হতে থাকে। এনজিও রাজের বাড়বাড়ন্ত দেখা দেয়। এরই মধ্যে বিদ্যাজ্যোতিতে ১০০-এর পাশাপাশি আরও ২৫টি স্কুলকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। গ্রামেগঞ্জের, মফস্সল শহরের স্কুলগুলিকে উপযুক্ত পরিকাঠামো ছাড়া, উপযুক্ত শিক্ষক ছাড়া গণহারে বিদ্যাজ্যোতি স্কুল করা হয়। এর জন্য ২০২৪ সালে প্রথমবারের মতো বিদ্যাজ্যোতির ফলাফল কী দাঁড়ায় তা রাজ্যবাসীর চোখের সামনে। বিদ্যাজ্যোতি স্কুলগুলির রাজ্যভিত্তিক গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান
মুখ্যসচিব, কনভেনার শিক্ষা দপ্তরের সচিব, জেলা কমিটির চেয়ারম্যান জেলাশাসক এএমসির চেয়ারম্যান মহকুমাশাসক প্রমুখ। কথা ছিল তারা নজরদারি চালাবেন। বিদ্যাজ্যোতি স্কুলগুলিতে পরিকাঠামো উন্নয়নে তারা সহায়তা করবেন প্রশাসনিকভাবে। কিন্তু কেউ কি বুকে হাত রেখে বলতে পারবেন বিদ্যাজ্যোতি স্কুলগুলিতে একদিনের জন্য গিয়ে তারা পরিকাঠামোর খোঁজ নিয়েছেন? এখন পশ্চিম জেলার জেলাশাসক বিদ্যাজ্যোতি স্কুলগুলির ফলাফল খারাপের জন্য শিক্ষকদের ডেকে যতই ধমকান, যতই শিক্ষকদের ইনক্রিমেন্ট বন্ধের নির্দেশ দেন, বদলির ফরমান দেন, শোকজ করার কথা বলেন আদতে তারও দায় রয়েছে? তিনি জেলাস্তরের চেয়ারম্যান হিসাবে কী করেছেন? এখন তিনি ফলাফলের পর কোথা থেকে উদয় হলেন?
তড়িঘড়ি এবার শিক্ষা দপ্তরের তরফে বিদ্যাজ্যোতি স্কুলগুলিতে শিক্ষক দেবার জন্য ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করেছেন এমন শিক্ষকদের লিস্ট চাওয়া হয়েছে। রাজ্যে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করেছেন বর্তমানে এমন শিক্ষক (সরকারী স্কুলে) ৫%ও খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাহলে কী হবে? বিদ্যাজ্যোতিতে ১০০টি স্কুল এবং পরবর্তীতে আরও ২৫টি স্কুল চালুর সময় কেন সরকারের এই কথাটি মনে পড়ল না যে বিদ্যাজ্যোতিতে পড়াতে গেলে শিক্ষকদের ইংরেজি মাধ্যম ব্যাকগ্রাউন্ড থাকা দরকার। সেক্ষেত্রে ইংরেজি মাধ্যম হলেই যে শিক্ষকরা পড়াতে পারবেন, আর না হলে পড়াতে পারবেন না এরও কোনও যুক্তি নেই। প্রশ্ন হল, একেবারে পরিকাঠামোহীন ভাবে ঢাল নেই তরোয়াল নেই, নিধিরাম সর্দারের মতো তড়িঘড়ি রাজ্য সরকার ১২৫টি সরকারী স্কুলকে কেন বিদ্যাজ্যোতিতে রূপান্তরিত করতে গেল? অবিলম্বে সরকারকে এ নিয়ে ভাবতে হবে। রাজধানী সহ মফস্সল শহরের একেবারে নামকরা স্কুলগুলিতেই ‘বিদ্যাজ্যোতি’ পরীক্ষামূলকভাবে চালু করার ভাবনাচিন্তা করুক রাজ্য সরকার। বাদবাকি স্কুলগুলিতে বিদ্যাজ্যোতি প্রকল্প স্থগিত রাখা হোক। এর আগে ওই সমস্ত স্কুলগুলিতে উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে তোলা হোক। শিক্ষকদের সিবিএসই’র উপযোগী পড়াশোনা করানোর জন্য যা যা করণীয় রাজ্য সরকারকে তা করতে হবে। এরপরে না হয় ফলাফল পর্যালোচনা করা যাবে। প্রথম বছরের ফলফলে গেল গেল রব তুলে আর যদি শিক্ষকদের গালমন্দ করে, বদলি করে, ইনক্রিমেন্ট বন্ধ করে দিয়ে বিদ্যাজ্যোতির সাফল্য আসবে ধরে নেয় দপ্তর এবং সরকার, তাহলে হয়তো ভুল হবে।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.