বিধানসভায় বিশাল জমি দুর্নীতির তথ্য ফাঁস করলেন কং- বিধায়ক!!

অনলাইন প্রতিনিধি:- শুক্রবার রাজ্য বিধানসভায় বড় ধরনের জমি দুর্নীতির তথ্য ফাঁস করলেন কংগ্রেস বিধায়ক সুদীপ রায় বর্মণ। শুধু বড় ধরনের দুর্নীতি বললে হয়তো কম বলা হবে। কেননা, অভিযোগটি অত্যন্ত মারাত্মক এবং রাজ্যের ইতিহাসে নজিরবিহীন কেলেঙ্কারি হিসাবে বিবেচিত হতে পারে, যদি সঠিকভাবে তদন্ত হয়। এই অভিযোগ আরও মারাত্মক এই কারণে যে, একজন জেলাশাসক প্রথমে এই ভয়ানক জমি কেলেঙ্কারির বিষয়টি রাজ্য সরকারের গোচরে নেওয়ার জন্য রাজ্য সরকারের জিএ (পি অ্যান্ড টি) দপ্তরের অতিরিক্ত সচিবকে চিঠি দিয়েছিল। কিন্তু বিষ্ময়ের ঘটনা হলো, জেলাশাসকের এই চিঠি পাওয়ার পর রাজ্য সরকার কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি বলে অভিযোগ। বিধায়ক সুদীপ রায় বর্মণের আরও অভিযোগ, এই চিঠি দেওয়ার পর ওই জেলা শাসককেই অন্য জেলায় সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সুদীপবাবুর বক্তব্য, রেভিনিউ দপ্তরটি মুখ্যমন্ত্রীর অধীনে। মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে এত বড় জমি দুর্নীতি চলছে, তিনি কি এই বিষয়ে ওয়াকিবহাল নন? জেলা শাসক তাঁর চিঠিতে নিজেই ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। সুদীপবাবু বলেন, একটি জেলাতেই যখন এই অবস্থা, তখন অন্য জেলাগুলিতে কী হয়েছে এবং হচ্ছে তা অনুমেয়। সুদীপবাবু এই ব্যাপারে সিবিআই তদন্তের দাবি জানান। সুদীপ বাবুর এই বক্তব্যে যদিও মুখ্যমন্ত্রী দাঁড়িয়ে বলেন, এই ব্যাপারে তিনি তদন্ত করে দেখবেন। তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো, বিধায়ক শ্রী বর্মন যখন বিষয়টি বিধানসভায় উত্থাপন করে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগের আঙুল তুলতে থাকেন, তখন বারবারই তাঁকে বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছিল। যদিও পরে তিনি এই বিষয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে করে বিস্তারিত তুলে ধরেন। শেষে বলেন, আমরা দেখতে চাই যিনি প্রায়ই স্বচ্ছতার কথা বলেন,সেই মুখ্যমন্ত্রী এই ব্যপারে কী ব্যবস্থা নেন। এদিন বিধানসভায় কংগ্রেস বিধায়ক সুদীপ রায় বর্মণের উত্থাপিত দুর্নীতির তথ্য এবং পরে সাংবাদিক সম্মেলনে দেওয়া তথ্য ও বক্তব্য থেকে যা জানা গেছে, তা রীতিমতো চোখ কপালে ওঠার মতো। স্বাভাবিকভাবেই জনমনে প্রশ্ন ওঠে সুশাসনের আড়ালে রাজ্য প্রশাসনে এসব কী চলছে? সুদীপবাবু অভিযোগ তুলে বলেন, । সিপাহিজলা জেলার প্রাক্তন জেলা শাসক ডা. বিশাল কুমার গত ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ইং তারিখে রাজ্য সরকারের জিএ (পি অ্যান্ড টি) দপ্তরের অতিরিক্ত সচিবকে No.F.12(4)-DM/ SPJ/CON/2023/1295 এই সেহামূলে একটি চিঠি দিয়েছিলেন। সেই চিঠিতে ছিল অবৈধভাবে জমি নামজারি এবং হস্তান্তরের সম্পর্কিত একাধিক তথ্য। তৎকালীন জেলাশাসক তাঁর চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, সাধারণ মানুষের কাছ থেকে পাওয়া বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে এই চিঠি লিখছেন। যেখানে তাদের (সাধারণ মানুষ) নিজস্ব জমি অন্য পক্ষের জমিতে কোনও তথ্য ছাড়াই স্থানান্তরিত করা হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে
যার নামে জমি হস্তান্তর করা হচ্ছে তিনি তাঁর বা তাঁদের পরিচিতই নন।তৎকালীন জেলাশাসক ডা. বিশাল কুমার তাঁর চিঠিতে আরও উল্লেখ করেছেন যে, এই ঘটনাগুলি গভীর বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে জমি হস্তান্তর কোনও ডকুমেন্টারি প্রমাণ ছাড়াই করা হয়েছে। যা ই-জমিতে আপলোড করা নথি থেকে স্পষ্ট। এই ধরনের মিউটেশনগুলি মাঠ অফিস থেকে করা সম্ভব নয়। এগুলো শুধুমাত্র পরিচালক ভূমি রেকর্ডের কাছে উপলব্ধ ব্যাক-এন্ড মডিউলের মাধ্যমেই করা যেতে পারে। জেলা শাসক আরও বলেছেন যে, আমি নিশ্চিত যে এক ব্যক্তির জমি অন্য ব্যক্তির জমিতে রূপান্তর স্পষ্টত দুষ্কর্ম। এই দুষ্কর্ম ভূমি মাফিয়া এবং ভূমি রেকর্ড ও সেটেলমেন্ট পরিচালকের কর্মকর্তার মধ্যে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে করা হয়েছে। জেলা শাসক তাঁর চিঠিতে কয়েকটি অবৈধ নামজারির তথ্য উল্লেখ করেছেন, সেগুলো ব্যাক এন্ড মডিউল ব্যবহার করে করা হয়েছে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। জেলাশাসক বলেছেন, এই পরিবর্তনগুলি কেবল একটি ছোট হিমশৈল মাত্র। আমরা ধারণা ১৪০০ কানিরও বেশি জমি এভাবে অবৈধভাবে হস্তান্তর এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই জমিগুলিকে যদি নগদীকরণ অর্থাৎ আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করা হয় তাহলে কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। চিঠিতে এর পরে তিনি আরও কিছু মারাত্মক তথ্য উল্লেখ করেছেন যে কীভাবে এই দুর্নীতিগুলি হয়েছে। যেমন সরকারী খাস জমি জোত জমিতে রূপান্তরিত করা হয়েছে। খাস জমি বরাদ্দকৃত জমি হিসাবে দেখানো হয় এবং তারপর অনুমতি ছাড়াই বরাদ্দকৃত জমি জোত জমিতে রূপান্তরিত করা হয়েছে। খাস বরাদ্দকৃত জমি যথাযথ অনুমতি ছাড়াই জোত জমিতেই রূপান্তর করা হয়েছে। চা বাগানের যে জমিতে বিক্রয়ের অনুমতি নিষিদ্ধ তা জোত জমিতে রূপান্তরিত করা হয় এবং পরে সেই জমি অনেক জনের কাছে টুকরো টুকরো করে বিক্রি করা হয়েছে। অনুমতি ছাড়াই জমি হস্তান্তর করা হয়েছে। পৌরসভার অনেক পুকুর ও জমি ব্যাপক এন্ড পরিবর্তনের মাধ্যমে বাস্তুতে রূপান্তরিত করা হয়েছে। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই অনুমোদিত দখলদারকে খতিয়ানের ১৬ নম্বর কলাম থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনুমতিপ্রাপ্ত দখলদারকে ১৬ নম্বর কলামে রাখা হয়েছিল, যার ফলে জমির মালিক কম দামে জমি বিক্রি করতে বাধ্য হন। শত্রু সম্পত্তির জমি (অর্থাৎ স্বাধীনতার পরে পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাওয়া ব্যক্তি তৃতীয় পক্ষের নামে জোত জমিতে রূপান্তরিত করা হয়েছে। মৃত ব্যক্তির জমি তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করা হয়েছে, ইত্যাদি। তৎকালীন জেলা শাসক তাঁর চিঠিতে আরও বলেছেন, পরিস্থিতি খুবই কঠিন। যেখানে গরিব মানুষ ভূমি মাফিয়াদের করুণার উপর নির্ভরশীল। যাদের পরিচালক ভূমি রেকর্ড ও সেটেলমেন্ট অফিসের সাথে ভালো সম্পর্ক রয়েছে। তারা ১০ মিনিটের মধ্যে যে কোনও জমির অবস্থা পরিবর্তন করে দরিদ্র মানুষকে তার জমি অর্ধেক বা এক চতুর্থাংশ বাজার মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য করতে পারে। যে ব্যক্তি
তাদের জীবনের একমাত্র আয় দিয়ে জমি কিনছেন, তিনিও প্রতারিত হয়েছেন, • কারণ আমাদের কিছু সরকারী কর্মকর্তা দুর্নীতিতে জড়িত। এই ভয়ানক দুর্নীতি কাণ্ডের সমাধান হিসাবে তৎকালীন জেলাশাসক জিএ (পিঅ্যান্ডটি) দপ্তরের অতিরিক্ত সচিবকে বলেছিলেন, অবিলম্বে ভূমি রেকর্ড ও সেটেলমেন্টের পরিচালক রত্নজিৎ দেববর্মা এবং একই অফিসের সিনিয়র কম্পিউটার সহকারী তাপস চৌধুরীকে অফিসে থেকে অপসারণ করা এবং তাদের বিরুদ্ধে বিস্তারিত তদন্ত করার জন্য। অধিদপ্তরে তিন বছরের বেশি সময় ধরে কর্মরত কর্মীদের অন্যত্র বদলি করার জন্য। একজন অবসরপ্রাপ্ত আইএএস অথবা টিসিএস অফিসারের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করার জন্য বলেছিলেন। এতে করে ই-জমি চালু হওয়ার পর থেকে করা সমস্ত মিউটেশন করা যাবে। জেলাশাসক আরও বলেছেন, সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে এবং স্বচ্ছ প্রশাসন নিশ্চিত করার জন্য রত্নজিৎ দেববর্মা এবং তাপস চৌধুরীকে অবিলম্বে অপসারণ করা উচিত বলে উল্লেখ করেছেন। এমন – আরও বেশকিছু অভিমত তিনি চিঠিতে উল্লেখ করেছেন। শেষে তিনি লিখেছেন, জেলার (সিপাহিজলা) ভূমি প্রশাসনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে আমি আশাবাদী যে রাজ্য প্রশাসন আমার উদ্বেগের বিষয়টি গুরুত্ব দেবে এবং রাজ্য সরকারের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার সহযোগিতায় সাধারণ মানুষের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ লুট করে নেওয়া ভূমি মাফিয়াদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে।
বিধায়ক সুদীপ বর্মণ বলেন, অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, এই চিঠি যাওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই জেলাশাসককে ওই জেলা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতিবাজ কর্মচারী ও ভূমি মাফিয়াদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা। সুদীপবাবু আরও বলেন, এই বিষয়টি আমার কাছে আগেই এসেছিল। আমি এই ব্যাপারে বিধানসভায় একটি প্রশ্ন জমা দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার এই সংক্রান্ত প্রশ্নটি বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। তাই আজ বিধানসভায় আমি বিষয়টি উত্থাপন করি এবং মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করি। রেভিনিউ দপ্তরটি মুখ্যমন্ত্রীর অধীনে। তিনিই এই দপ্তরের মন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে এতবড় দুর্নীতি চলছে গত কয়েক বছর ধরে, তিনি এই বিষয়টি জানেন না? সব থেকে মারাত্মক ঘটনা হলো, একজন জেলাশাসক, তার উর্ধ্বতনকে চিঠি দিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনি আবেদন করেছেন কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। কিছুই করা হয়নি। আজ বিষয়টি উত্থাপন করার পর মুখ্যমন্ত্রী বলছেন বিষয়টি তিনি তদন্ত করে দেখবেন। সুদীপবাবু বলেন, আমি এই বিষয়ে সিবিআই তদন্ত দাবি করেছি। কেননা, এটি ছোটখাটো দুর্নীতি নয়। এক জেলাতেই এই অবস্থা, তাহলে অন্য জেলাগুলোতে কি চলছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। সব থেকে উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, জেলাশাসকের এই চিঠি থেকে স্পষ্ট সুশাসনের নামে রাজ্যে দুর্নীতির প্রতিযোগিতা চলছে। এভাবে চলতে পারে না। এখন দেখবো মুখ্যমন্ত্রী কি ব্যবস্থা নেন।
