বিপজ্জনক প্রবণতা।

 বিপজ্জনক প্রবণতা।
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

চলন্ত জয়পুর-মুম্বাই সেন্ট্রাল সুপারফাস্ট এক্সপ্রেসে গত সোমবার ভোরে চেতন সিং নামে বছর তেত্রিশের এক আরপিএফ কনস্টেবল নিজের রাইফেল থেকে প্রথমে তারই বাহিনীর এএসআই টিকারাম মিনাকে গুলী করেন।তারপরে বিভিন্ন কামরায় ঘুরে ঘুরে বেছে বেছে তিনজন সংখ্যালঘুকে গুলী করেন। এই নিন্দা করে কোনও টুইট করেননি দেশের রেলমন্ত্রী।এমনকী,ট্রেনে এমন বর্বরতা বরদাস্ত করা হবে না বলেও রেলের তরফে কোনও বিবৃতি জারি করা হয়নি।সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিয়োয়(সত্যাসত্যের তদন্ত চলছে)দেখা গিয়েছে, গুলী করে হত্যার পরে ওই কনস্টেবল বলছেন,’ওরা পাকিস্তান থেকে কাজ করে। দেশের সংবাদমাধ্যম সেটাই দেখাচ্ছে।ওরা সব জানে, ওদের নেতারা ওখানে রয়েছে।যদি ভোট দিতে হয়, যদি ভারতে থাকতে হয়, তাহলে শুধু মোদি ও যোগী দু’জন আছেন।’ ওই ঘটনার পরেই অন্যদিকে হরিয়ানার নুহ, মেওয়াতে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি)-র মিছিলকে কেন্দ্র করে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে হিংসা ছড়ায়। তার জেরে মঙ্গলবার ফের দিল্লীর কাছে হরিয়ানার গুরুগ্রামে হিংসার আগুনে অন্তত পাঁচজনের মৃত্যু সহ আহত হন পঞ্চাশের উপর মানুষ।নুহয়ের এই ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ভাবলে ভুল হবে। গত দশ বছরে বারংবার হরিয়ানার মেওয়াত অঞ্চল থেকে সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক ঘটনা সামনে এসেছে। কখনও মহাপঞ্চায়েত থেকে, কখনও ভিডিও বানিয়ে, কখনও ধর্মীয় যাত্রার নাম করে প্রকাশ্যে নির্দিষ্ট একটি সম্প্রদায়ের মানুষকে নিকেশের ডাক দেওয়া হয়েছে। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় এবং আগামী বছর লোকসভা নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে, এক শ্রেণীর বশংবদ সংবাদমাধ্যমের যোগ্য সঙ্গতে সমাজে চেতন সিংদের দাপট বাড়তে থাকবে।চলন্ত ট্রেনের কামরায় চেতন সিং যা করেছেন তা হলো এক সম্প্রদায়ের প্রতি নিজের শক্তি প্রদর্শন। দর্শন বলে, শক্তি প্রয়োজন হয় বিরোধের জন্যই। গত পরশু আসামের দারাং জেলার মরনোই গ্রামের একটি খবর প্রকাশ্যে এসেছে। রাষ্ট্রীয় বজরং দল নামে একটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠন অতি সাধারণ ঘরের প্রায় সাড়ে তিনশো তরুণকে ‘রক্ষক’ তৈরি করতে পুরোদস্তুর অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। উদ্দেশ্য হলো, ‘লাভ জিহাদ’ রুখে দেওয়া! কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ২০২০ সালে লিখিত প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছিল, ‘লাভ জিহাদ’ বলে কিছুর অস্তিত্ব আইনে নেই। অথচ তা নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার কৌশল অব্যাহত। ওই প্রশিক্ষণ শিবির থেকে ‘প্রশিক্ষিত’ নিম্নবিত্ত ঘরের তরুণ ‘রক্ষকেরা’ পরে গুলী চালালে তখন কিন্তু ভারতীয় দণ্ডবিধি ছেড়ে কথা বলবে না। গারদে পুরবে।এই প্রবণতাই বিপজ্জনক।ক্ষমতা রাজধর্ম পালন না করে মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে অবর্ণনীয় বিপর্যয় ও সঙ্কটের দিকে। ক্ষমতাতন্ত্র নিজের সন্তানদের দুধে-ভাতে রেখে বাকিদের ‘ধরম খতরে মে হ্যায়’ নামক বায়বীয় এক প্রচারে ভুলিয়ে অপরাধী তৈরি করতে চাইছে। চাইছে, এ কালের গরিব প্রজন্ম ঘর-সংসার চালাতে জীবনের প্রাত্যহিক সংগ্রাম ভুলে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে লড়াইয়ে নামুক। এই ‘লড়াই’ আজকের সমাজে এক ব্যাধির রূপ নিয়েছে এবং ততোধিক উদ্বেগের বিষয়, সেই ব্যাধিকে রাজনীতির মোড়কে আপনও করে নিয়েছে এই সমাজ।
এই ব্যাধিই চেতনকে ঘাতকে পরিণত করেছে।প্রশ্ন হলো, ধর্ম যখন এতটাই সঙ্কটাপন্ন, তখন তাকে রক্ষার দায় শুধুমাত্র গরিব ঘরের ছেলেদের উপরেই বর্তাবে কেন? শুধু তারাই কেন মাথায় ফেট্টি বেঁধে, ডিজে বাজিয়ে, গৈরিক পতাকায় আঁকা ক্রুদ্ধ পবনপুত্রের ছবি নিয়ে রাস্তায় শোভাযাত্রায় অংশ নেবে, বিকট পৌরুষ প্রদর্শন করবে, উস্কানিমূলক বক্তব্যে অন্য কাউকে প্ররোচিত করে নিজেরা গর্হিত অপরাধে জড়িয়ে পড়বে, গ্রেপ্তার হবে, জেলে যাবে কেন? নাগরিকতা আন্দোলনের সময় দিল্লীতে যে নেতা ‘গোলি মারো’ নিদান দেন, মন্ত্রিসভায় তার পদোন্নতি হয়। আর ওই নেতার নিদানে কপিল গুর্জর নামে যে তরুণ ‘হিন্দুরাষ্ট্র জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিয়ে গুলী চালান তার জেলযাত্রা হয়। ধর্মের নামে রাজনীতি করে নেতা দেবতায় পরিণত হবেন, আর কপিল গুর্জর, চেতন সিংয়ের মতো অতি সাধারণ ঘরের সন্তানেরা কুকর্মের ভাগীদার হয়ে দাঙ্গাকারী’ অথবা ‘খুনি’র তকমা পেয়ে কারান্তরালে থাকবেন,এই বিপজ্জনক প্রবণতার পূর্ণচ্ছেদ দরকার।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.