বিভ্রমের আবর্তে!!

এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

লোকসভা নির্বাচনের অপরাহ্ণে এসে পৌঁছেছি আমরা।আগামী শনিবার ১ জুন সপ্তম পর্বে ভোট হলেই সম্পন্ন হবে দীর্ঘ চুয়াল্লিশ দিনব্যাপী অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন।কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভয়াল রূপ,সমধিক কদর্য ডিপ ফেক, সর্বোপরি সমাজমাধ্যমের দেশ ও সমাজের অর্বাচীন অভিভাবক হয়ে ওঠার সাক্ষী এই নির্বাচন।ভোট যত গড়িয়েছে, হার-জিতের সম্ভাবনা নিয়ে দাবি ও পাল্টা দাবিতে তত সরগরম হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক বাসর। নির্বাচনের ষষ্ঠ পর্ব শেষে যোগেন্দ্র যাদবের মতো দেশের অন্যতম ভোট বিশ্লেষক মনে করছেন, বিজেপি আড়াইশোর আশেপাশে থাকবে।এনডিএ জোট ধরলে হিসাবটা ম্যাজিক সংখ্যা ২৭২-এর কিছুটা হলেও নিচে থাকবে। একে কেউ বলতেই পারেন, যোগেন্দ্র ঘোষিতভাবে বিজেপিবিরোধী।আবার এটাও ঠিক, তিনি পেশাদার রাজনৈতিক রাশিবিদ।প্রলাপ বকলে তার পেশাদারি বিশ্বাসযোগ্যতাই নষ্ট হবে। যোগেন্দ্র ছাড়াও একাধিক বিশ্লেষক এনডিএ-কে ২৬০-এর তলায় নামিয়ে দিয়েছেন। আবার তাদের পাল্টা ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোর দাবি করে চলেছেন, উনিশের ফলাফলের মতোই বিজেপি তিনশোর বেশি আসনে জয়ী হবে।প্রশান্ত কিশোর এক আগে অনেক ভোট ফল যেমন প্রায় মিলিয়ে দিয়েছেন,তেমনই একাধিক রাজ্যের নির্বাচনে তার ভবিষ্যদ্বাণী ব্যর্থও হয়েছে।
এটা ঠিকই যে, দশ বছর দেশ শাসনের পরেও বিজেপির সর্বাধিনায়ক নরেন্দ্র মোদি কোনও একটি বা দুটি নির্দিষ্ট কর্মসূচিকে সামনে রেখে ভোট চাইতে পারছেন না।এই প্রবণতা দেখে বিশ্লেষকদের অনেকেরই মনে হচ্ছে, ভোট যত গড়িয়েছে, শাসক দল বুঝতে পারছে খেলা ক্রমশই কঠিন হচ্ছে। তাই কুকথা, বিদ্বেষ, বিষোদগার এবং মিথ্যার বেসাতি অনিরুদ্ধ হয়েছে।অতিসম্প্রতি একটি জনসভায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘বিরোধীরা ভোটব্যাঙ্ক রক্ষার জন্য ওদের কাছে গিয়ে মুজরো করুক’। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর মুখে এই বক্তব্য নিশ্চিতভাবেই শোভনীয় নয়। এবার সিংহভাগ নেতার ভাষণের সংকলন যদি কখনও কেউ করেন, আমরা দেখব, এই নির্বাচন নেতাদের মুখের সব আগল খুলে দিয়েছে। অনেকে বলেন, প্রত্যুষ দেখলে সারাদিনের একটা আভাস পাওয়া যায়। অথচ, নির্বাচনের প্রারম্ভ যথার্থই ছিল।উন্নয়নের ফিরিস্তি আর দেশবাসীকে সোনালি দিনের অভিপ্রায় শুনিয়ে ভোটভিক্ষা শুরু করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী।মনে হয়েছিল, খেলা একতরফা।অব কি বার চারশো পার না হলেও তিনশোর পার তো বটেই।কিন্তু নির্বাচনের প্রথম দুটি পর্বান্তরের পরেই ভাষণ এবং আক্রমণের আয়ুধ বদলে গেল। বিবিধ হুঙ্কারে শুরু হল ভিন্ন সুর ও স্বর।একপক্ষ সংখ্যালঘু তোষণের বিরোধিতাকে ভোটের মোক্ষমতম চাল করে নিলেন।আবার কেউবা কারও ভাষণের অভিমুখে স্পষ্ট, নিজ রাজ্যে সংখ্যালঘুর ‘উন্নয়ন’-এর প্রতিশ্রুতি থেকে ভোটের আগে গলার স্বর একপর্দাও খাদে নামানো যাবে না। বদল দেখা গেল সংবাদমাধ্যমের একাংশ থেকে শুরু করে আমলা, এমনকী বিচারব্যবস্থার মধ্যেও। কৌস্তুভ রায় বনাম ইডি মামলার বিচারে একটি নিম্ন আদালতের বিচারক তাৎপর্যপূর্ণভাবে মন্তব্য করলেন, ‘ইডি দেশের প্রিমিয়ার একটি তদন্তকারী সংস্থা।ধরে নেওয়া হয় যে সব দক্ষ অফিসারেরা এখানে রয়েছেন। এ তো দেখছি অদক্ষ সব অফিসারে এজেন্সি ভরে গেছে, তদন্তই হচ্ছে না। শুধুমাত্র পেপারওয়ার্কে মামলা সাজানো হচ্ছে।’কেজরিওয়াল অন্তর্বর্তীকালীন জামিন পেলেন শুধুমাত্র নির্বাচনি প্রচারের জন্য। পাঁচ বছর পর জেল থেকে মুক্তি পেলেন ইউএপিএ আইনে বন্দি থাকা কাশ্মীরের সাংবাদিক আসিফ সুলতান।এলগার পরিষদ মামলায় দীর্ঘদিন ধরে গৃহবন্দি থাকার পর সুপ্রিম কোর্টে জামিন পেলেন অধিকার রক্ষা কর্মী গৌতম নওলখা।ইউএপিএ মামলাটাই খারিজ করে, গ্রেপ্তারিকেই বেআইনি আখ্যা দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট জামিন দিল নিউজক্লিকের ঘোষিত বামপন্থী সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থকে।
এই ‘ক্রোনোলজি’ থেকে তবে কী দাঁড়াল?বস্তুত, বিভ্রম ছাড়া কিছুই দাঁড়াল না। অজস্র মত এবং পাল্টা মত, দাবি এবং পাল্টা দাবিতে এবার যেন রাজনৈতিক বিভ্রমই নির্বাচনের ‘নেপথ্য নায়ক’।সাধারণ জনতার যেন এটাই নিয়তি, বিভ্রমের আবর্তে এই দোদুল্যমানতা। স্নায়ুবিজ্ঞান সেই কবেই প্রমাণ করেছে ‘সিয়িং ইজ নট বিলিভিং’। মানুষের অভিজ্ঞতাই তার বাস্তবকে নির্মাণ করে। আইনস্টাইন সেই কবেই আমাদের শুনিয়ে দিয়েছেন, রিয়‍্যালিটি ইজ মিয়ারলি অ্যান ইলিউশন, বাস্তব কেবল এক বিভ্রমমাত্র।যে বাস্তবকে আমরা দেখি, বিশ্বার করি, তা কার্যত আমাদেরই রচনা। ভারতের অষ্টাদশ সাধারণ নির্বাচন তা আর ও একবার প্রমাণ করেছে।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.