বিমার যন্ত্রণা!!

 বিমার যন্ত্রণা!!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে বটে, তবে সমধিক দ্রুত বাড়ছে রোগ বিরোগ এবং তজ্জনিত কারণে চিকিৎসার বিপুল খরচ।কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারী স্তরে নিঃশুল্ক স্বাস্থ্য বিমা থাকলেও, তুমুল ঢক্কানিনাদের আড়ালে সাধারণ মানুষ শারীরিক দুর্ভোগে পড়লে তার কতটা কাজে আসে ভুক্তভোগীরা হাড়ে-মজ্জায় অবহিত।উচ্চ আয়সম্পন্ন পরিবারের তেমন সমস্যা নেই কারণ বেসরকারী স্বাস্থ্য বিমার চড়া প্রিমিয়াম তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে না।কিন্তু মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার? বিশেষত স্বল্প বিত্তের আয়ের প্রবীণ মানুষেরা?আমাদের এই রাজ্যে উন্নততর চিকিৎসা পরিষেবা আজও অপ্রতুল। জটিল অসুখে আক্রান্ত হলেই রোগীর সঙ্গে একাধিক পরিজনকে কলকাতা, বেঙ্গালুরু কিংবা চেন্নাই উড়ে যেতে হয়। চিকিৎসা-ব্যয়ের সঙ্গে যুক্ত হয় পরিবহণ ও রাহা খরচ।ক্যান্সার হোক কিংবা হার্টের সমস্যা, কিডনির অসুখ হোক বা লিভার সিরোসিস -কঠিন রোগের সঙ্গে মৃত্যুভয়ের পাশাপাশি জড়িয়ে থাকে চিকিৎসার খরচ সংক্রান্ত চরম দুশ্চিন্তা।আপনজনের চিকিৎসা করাতে গিয়ে ঘটি-বাটি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে বহু পরিবারের।এই সূত্রে তৈরি হয়েছে নতুন শব্দবন্ধ ‘মেডিকেল পভার্টি’।এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বিমা করা
থাকলে কিছুটা ভার লাঘব হয়।
বিশ্ব জুড়ে এখন রমরমিয়ে চলছে স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যবসা।অথচ প্রকৃত প্রস্তাবে, এক্ষেত্রে সেবার নামে চলছে শোষণ।যে দিন থেকে স্বাস্থ্যবিমা বাজারে এসেছে সে দিন থেকেই নামী-দামি চিকিৎসালয়গুলি পরিষেবা ভুলে স্বাস্থ্য ব্যবসায় নেমেছে। ভারতবর্ষে সরকারী হাসপাতালের মোট শয্যা-সংখ্যা যা, তার চেয়ে বেসরকারী হাসপাতালের শয্যা অনেক বেশি। ২০২১-এর এক সমীক্ষা বলছে, দেশে সরকারী হাসপাতালে ৮,২৫,২৩৫ শয্যা আছে। অর্থাৎ, প্রতি ১০০০ জনসংখ্যায় ০.৬ শতাংশ শয্যা রয়েছে।মানুষ অতএব বাধ্য হচ্ছেন বেসরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে। আর এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে প্রয়োজন বিপুল অর্থ, এহ বাহ্য রোগীর পরিবার জানতেও পারে না, ঠিক কোন খাতে খরচের বহর কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে। অত:কিম মানুষকে ছুটতে হচ্ছে বিমা কোম্পানিগুলির কাছে।তারাও সুযোগের ‘সদ্ব্যবহার’ করে চলেছে, মর্জি মাফিক বাড়িয়ে চলেছে বিমার প্রিমিয়াম।বিশেষত, প্রবীণদের জন্য বিমা সংস্থাগুলি যে হারে প্রিমিয়াম বৃদ্ধি করছে, তার সঙ্গে প্রদেয় সরকারের ১৮ শতাংশ জিএসটি, এক কথায় অমানবিক, পরোক্ষে যাকে রাষ্ট্রীয় শোষণ বললেও অত্যুক্তি হয় না।একজন অবসরপ্রাপ্ত মানুষ তার ও তার স্বামী বা স্ত্রীর স্বাস্থ্য বিমা করতে গেলে এখন খরচ পড়ছে প্রায় কমপক্ষে ৭৫ হাজার টাকা। তার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে চড়া জিএসটি। মজার বিষয় হলো, ৭৫ হাজার টাকা প্রিমিয়াম দিয়ে ৮০ ডি-তে আয়কর ছাড় মিলছে ৫০ হাজার টাকা। কেন এমন নিয়ম? তর্কাতীত সত্য এই যে, মানুষের আয়ুবৃদ্ধির সুযোগ যেমন বিমা কোম্পানিগুলি নিচ্ছে, তেমনই নিচ্ছে সরকারও। কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত প্রবীণ নাগরিকদের বিমার প্রিমিয়াম কমানোর জন্য আইআরডিএ-কে কড়া নির্দেশ দেওয়া আর বিমার পুরো প্রিমিয়ামেই আয়কর ছাড় দেওয়া।সেই সঙ্গে বিমার জিএসটি বিমা গ্রহীতার কাছ থেকে নয়,নেওয়া হোক বিমা কোম্পানিগুলির থেকে।
এর সমান্তরালে বেসরকারী হাসপাতালগুলিতে রোগীদের উপর যে অস্বাভাবিক খরচ চাপানো হয়, তাতে নজরদারি চালাতে হবে রাজ্য সরকারকে।তাছাড়া ১৮ শতাংশ জিএসটির যে ৯ শতাংশ রাজ্য পায়, সেটিও মকুব করলে সুবিধা হয় প্রবীণদের। অনেক সরকারী হাসপাতালে এখনও সুচিকিৎসা হয়, আর খরচও মানুষের সাধ্যের মধ্যে।এখানে যে প্রবীণদের চিকিৎসা পরিষেবার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন,সেটি যেন তারা পান তা সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে।
পরিস্থিতি এতটাই ঘোরালো হয়ে উঠেছে যে, স্বাস্থ্য বিমার খরচ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন খোদ বিমা নিয়ন্ত্রক আইআরডিএ-র চেয়ারম্যান দেবাশিস পাণ্ডা। বছর দুই বছর (অতিমারি-পরবর্তী সময়ে) আগে দিল্লীতে এ সংক্রান্ত এক সম্মেলনে তিনি সখেদে মন্তব্য করেন, পলিসি কেনার খরচ এত বেড়েছে যে, দেশে বিমার প্রসার বাধা পাচ্ছে।কোভিড দিয়েছে স্বাস্থ্য বিমার প্রয়োজনীয়তা।কিন্তু প্রয়োজন বুঝলেও অনেকেরই চড়া প্রিমিয়াম গোনার সাধ্য নেই।উল্টে বহু পুরনো গ্রাহক স্বাস্থ্য বিমা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন। আসলে এ ক্ষতি সামাজিক। আরও রহস্যের বিষয়, নগদ টাকা দিয়ে চিকিৎসা করালে যা বিল হয়, রোগীর বিমা থাকলে সেটি হয় অনেক বেশি।স্বাস্থ্য পরিষেবার নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ তৈরি না হলে এই অন্যায়গুলি আটকানো যাবে না।স্বাস্থ্য বিমা আমজনতার রক্ষাকবচ। সামাজিক কল্যাণের বিষয়। সরকার এই পরম সত্যটি অনুধাবন না করলে বিমা নামক যন্ত্রণা থেকে মুক্তির সম্ভাবনা শূন্য।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.