বিলীন হয়ে যাচ্ছে রজনীকান্ত সেনের পৈতৃক বাড়ি, দেখার কেও নেই!!

 বিলীন হয়ে যাচ্ছে  রজনীকান্ত সেনের পৈতৃক বাড়ি,  দেখার কেও নেই!!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

শ্যামল সান্যাল,ঢাকা।।
“বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই,কুড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই- আমি থাকি মহা সুখে অট্টালিকা পরে,তুমি কত কষ্ট পাও রোদ বৃষ্টি ঝড়ে” প্রখ্যাত এই কবিতাটি শুনলেই যার নামটি সবার স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে, তিনি হলেন উপমহাদেশের বরেণ্য কবি এবং সিরাজগঞ্জবাসীর গর্বের ধন কান্ত কবি রজনী কান্ত সেন। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ও সরকারী ভাবে কোন সহযোগিতা না থাকায় আজ কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে কান্ত কবি রজনী কান্ত সেনের পৈতিক বাড়িটি। ভুলে যেতে বসেছে পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জবাসী তাদের গর্বের কবি রজনীকান্ত সেনকে।


সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি থানার ভাংঙ্গাবাড়ীর তাঁর পৈতৃক বাড়িটি আজ ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে। এই বাড়িতে গুপ্তধন লুকায়িত আছে বলে বাড়িটি ভেঙে ফেলে স্বার্থান্বেষী মহল। একেবারে মাটি খুড়ে তুলে ফেলা হয়েছে। স্বাধীনতার পর পার্শ্ববর্তী মোয়াজ্জেম হোসেন নামক জৈনক ব্যক্তি কবির বাড়ির সামনের বিরাট পুকুর ও জমি জাল দলিলের মাধ্যমে ভোগ দখল করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এলাকাবাসি এই ব্যাপারে প্রতিকার চেয়েও কোন ফল পায়নি। বর্তমানে সেখানে ছোট ছোট ঘিঞ্জি ঘিঞ্জি কয়েকটি ঘর। পাশে দুটি পুকুর কালের সাক্ষ্য বহন করে চলছে। মাটিতে লুটিয়ে আছে ইট-সুরকির স্মৃতিচিহ্ন। কবির বাড়ির পুরনো দালানের ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি মোটা এবং পুর দেয়ালের অংশ ছাড়া কিছুই দেখা যায়না। লোক মুখে শোনা যায়, কুচক্রীরা রাতারাতি কবির বাড়ি ধ্বংস করে নিজেদের দখলে নিয়েছে। নানা কারনে সেন বাড়ির স্মৃতি চিহ্ন মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে বলে এলাকাবাসী অভিযোগ করেন। দেশের যে কজন প্রখ্যাত কবি ও মনীষি রয়েছেন, বাংলাদেশের মানুষ তাদেরকে অনেক শ্রদ্ধার সাথে তাদের জন্ম ও মৃত্যু দিবস উপলক্ষে বৃহত্তর পরিসরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে স্বরণ করে এবং নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রেনিত করে, কবি রজনীকান্ত সেন তাদের মধ্যে অন্যতম । এসব কবি ও মনীষিদের কাতারে দাঁড়িয়ে আছে সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার কৃতি সন্তান কান্ত কবি রজনী কান্ত সেন। তাকে স্বরনীয় করে রাখতে বেলকুচি উপজেলার সেন ভাংঙ্গাবাড়ী গ্রামে রজনী সংসদ ও স্মৃতি পাঠাগার নামে একটি ক্লাব স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিবছর স্বল্প পরিসরে এই ক্লাবকে কেন্দ্র করে কবির স্বরণে বিভিন্ন খেলাধুলাসহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় । কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ও সরকারী ভাবে কোন সহযোগিতা না থাকায় সিরাজগঞ্জ জেলা সদর ও দেশের অন্য কোথাও কান্ত কবি রজনী সেনকে তার জন্ম ও মৃত্যু দিবসে স্মরণ করা হয় না।

রজনী কান্ত সেন ১৮৬৫ সালের ২৬ জুলাই বাংলা ১২৭২ সালের ১২ শ্রাবন বুধবার সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি উপজেলার সেন ভাঙ্গাবাড়ী গ্রামের বৈদ্যবংসের সেন পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। ইতিহাস সমৃদ্ধ সিরাজগঞ্জের গর্ভে যে ক’জন সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক মনীষী জন্ম গ্রহন করেছেন রজনীকান্ত সেন তার মধ্যে অন্যতম। পিতামহ গোলকনাথ সেনের দুই পুত্র। গোবিন্দনাথ সেন (বড়) ও গুরু প্রসাদ সেন (ছোট)। এই গুরু প্রসাদ সেনই রজনীকান্ত সেনের পিতা। তার ৩ পুত্র এবং২ কন্যার মধ্যে রজনীকান্ত তৃতীয়। রজনীকান্ত যখন ভাঙ্গাবড়ীতে জন্মগ্রহন করেন, তখন তার বাবা কাটোয়ারার মুনসেফ। কিছুদিন পর কালোনায় বদলি হন। মা রজনীকে নিয়ে স্বামীর কাছে যান। তার শৈশবের বেশির ভাগ সময় বাবার কর্মস্থলে কাটে। রজনী তখন থেকেই স্বরচিত গান বলতে শুরু করেন, তা আজও অজানাই রয়ে গেছে। তবে তিনি যে ছোট বেলা থেকে গান কবিতা বলতেন তা সবাই জানতেন। ছোট বেলা থেকেই তিনি গান শুনে সুর ও ভাষা আয়ত্ত করতেন। তিনি যখন সবে মাত্র লেখাপড়া শুরু করেন তখনই তিনি রামায়ণ মহাভারত প্রভিতি গ্রন্থের অংশ লোক মুখে শুনে কন্ঠস্ত করতেন। পিতার কোলে বসে অসংকোচে রামায়ণ/মহাভারতের নানা অংশ আবৃতি করে শোনাতেন।এসময় তিনি হস্তপদাদি অবয়বের ইংরেজি প্রতি শব্দ কন্ঠস্ত করতেন। শারদীয় পূজার সময় দেব-দেবীর প্রতিমা দেখে ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় অপূর্ব ভঙ্গিতে দেব-দেবীদের রুপের বর্ণনা দিতেন। যা এক কথায় অপূর্ব।

তিনি রাজশাহীর বোয়ালীয়া জেলা স্কুলে ভর্তি হন। বর্তমানে যা বাংলাদেশের রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল। গাছ থেকে ফল চুরি করে সহপাঠিদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন এবং পাখির বাসা ভেঙে শাবক নিয়ে খেলা করতে ভাল বাসতেন। গাছ থেকে পরে কয়েক বার তার হাত ভেঙে গিয়ে ছিল। বই একবার পরলেই মুখস্ত হয়ে যেত। তিনি কখনও বেশী পড়তেন না।পরীক্ষার কয়েক দিন আগে সামান্য পড়েই প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতেন। তিনি ১৮৮২ সালে কুচবিহার জেনকিন্স স্কুল থেকে দ্বিতীয় বিভাগে এন্ট্রাস পাস করে ১০ টাকার সরকারি বৃত্তি লাভ করেন।এসময় রাজশাহী বিভাগীয় স্কুলের প্রতিযোগিতায় ইংরেজি প্রবন্ধ লিখে মাসিক ৫ টাকা হারে প্রমথনাথ বৃত্তি লাভ করেন। তিনি রাজশাহী কলেজ থেকে এফএ ডিগ্রী লাভ করেন। ১৮৯১সালে বিএল পাশ করে রাজশাহী আদালতে আইন ব্যবসা শুরু করেন। কিছুদিন নাটোরও নওগাঁয় অস্থায়ী মুনসেফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জ্যাঠাতো ভাই কালিকুমার সেনের কাছে রজনী কবিতা রচনা করতে শেখেন। প্রকৃত পক্ষে কালিকুমাররই রজনী কান্তের কাব্য গুরু। তারই উৎসাহে রজনীকান্ত বাল্যকাল থেকে কবিতা লিখতে শুরু করেন। তিনি নিজেই গান লিখতেন এবং গাইতেন।১২৯৭ বাংলা সালের ভাদ্র মাসে মাসিক আশালতা পত্রিকায় রজনীকান্তের আশা নামক প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। রজনীকান্ত সেন ছিলেন স্বরচিত গানের সুকন্ঠ গায়ক।তার গান বিষয়বস্তুর দিক থেকে ৪ ভাগে বিভক্ত ছিল।

দেশাত্মবোধক, ভক্তিমূলক, প্রীতিমূলক এবং হাস্য রসের গান। রজনীকান্তের দেশাত্মবোধক গানের আবেদন ছিল ব্যাপক। স্বদেশী আন্দোলন ১৯০৫-১৯১১ চলাকালে “মায়ের দেয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেড়ে ভাই- ” গানটি রচনা করে অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি করেন। কবি হিসেবেও খ্যাত ছিলেন তিনি। নির্মল আবেগ ও কোমল সুরের ব্যঞ্জনায় তার গান ও কবিতা সমৃদ্ধ।১৯০২ সালে বাণী গ্রন্থটি তার প্রথম প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯০৫ সালে কল্যাণী, ১৯১০ সালে অমৃত আনন্দময়ী, বিশ্রাম ও অভয়া। ১৯১৩ সালে শেষদান ও সদ্ভাব কুসুম প্রকাশিত হয়। এই আটটি কাব্যগ্রন্থের আধিকাংশ কবিতাই গীত। বাণী ও কল্যাণী রজনীকান্তের গানের সঞ্চায়ন। ১৩১৬ বাংলায় তার মুখে ঘা দেখাদেয়। ক্রমেই তার স্বরভঙ্গ হতে থাকে। ওষুধে কাজ হয়না। রোগ বৃদ্ধি পেতে থাকে। একই বছর ২৬ ভাদ্র তিনি পরিবার বর্গের সাথে কলকাতায় যাত্রা করেন। ভাঙাবাড়ীর জন্ম ভুমি থেকে এটি তার চির বিদায়। কলকাতায় গিয়ে গলায় ক্যান্সার ধরা পড়ে। গলায় অস্ত্রোপচার করা হয়। চিরদিনের জন্য বন্ধ হযে যায় তার বাক শক্তি। এ যাত্রায় রক্ষা পেলেও বেশি দিন বেঁচে ছিলেন না তিনি। মাত্র ৭ মাস জীবিত ছিলেন। পুনরায় অসুখ বাড়তে থাকে। শত চেষ্টা করেও ফল পাওয়া যায়নি। ১৯১০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর তিনি পরলোক গমন করেন। উপমহাদেশের বাংলা ছায়াছবির কিংবদন্তি নায়িকা সুচিত্রা সেন এই ভাঙাবাড়ির কান্ত কবির বাড়িতেই জন্ম গ্রহন করেন।সুচিত্রা সেনের প্রাইমারি শিক্ষা এখানেই চলেছে।

কবি রজনীকান্ত সেন তার নানা।এলাকা বাসি জানায়,খ্যাতিমান অভিনেত্রি সুচিত্রা সেন বাংলাদেশে বেড়াতে এসে তার জন্ম ভূমি নানার বাড়িটি ধ্বংসকৃত দেখে অশ্রু সজল চোখে ফিরে জান। রজনীকান্তের বিলাসবহুল বাড়িটির পাকা ল্যাট্রিনটি কাত হয়ে এখনোপড়ে আছে কালের সাক্ষী হিসেবে। ১৯৩৮সালে রজনী সংসদ ও স্মৃতি পাঠাগার নামে একটি ক্লাব স্থাপন করা হয়। প্রতিবছর এই ক্লাবকে কেন্দ্র করে রজনীকান্ত স্বরনে বিভিন্ন খেলাধুলা সহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। গত বছর স্থানীয় সংসদ সদস্য আব্দুল মজিদ ও শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলীসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা একটি অনুষ্ঠানে এসে দেশের এই বরেণ্য কবির স্মৃতি ধরে রাখার জন্য যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহন করার প্রতিশ্রুতি দিলেও, আজ পযর্ন্ত বাস্তবে প্রতিফলন ঘটেনি। এনিয়ে বেলকুচি তথা সিরাজগঞ্জবাসী ও বুদ্ধিজীবী মহলে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করেছে। অন্য সকল কবির মত কান্ত কবির স্মৃতি রক্ষার্থে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে এগিয়ে আসার জন্য জোর দাবি জানিয়েছেন সিরাজগঞ্জবাসী।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.