বৈবাহিক ধর্ষণ!!
সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিয়ে নরেন্দ্র মোদি সরকার সময়ের এমন এক সন্ধিক্ষণে বৈবাহিক ধর্ষণকে ধর্ষণের পরিধি থেকে স্বতন্ত্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করলো, যখন কলকাতায় এক তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার বিচার চেয়ে গত দুই মাস ধরে কার্যত উত্তাল নাগরিক সমাজ।’বৈবাহিক ধর্ষণ’ সম্বন্ধে কেন্দ্রের বক্তব্য, কোনও অপরিচিত ব্যক্তি যখন কোনও নারীকে ধর্ষণ করে, তখন সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে যে কঠোরতম আইন প্রয়োগ করা হয়,বৈবাহিক ধর্ষণের ক্ষেত্রেও যদি সেই একইরকম কঠোর আইন প্রয়োগ করা হয়, তাহলে তা বিবাহিত জীবনকেই অস্থির করে তুলবে।
ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় ৩৭৫ ধারার ৩ উপধারায় বৈবাহিক ধর্ষণকে ‘ব্যতিক্রম’ বলে ছাড় দেওয়া হয়েছে।তা নিয়ে ইতিমধ্যে সুপ্রিম কোর্টে একাধিক আবেদন জমা পড়েছে।আবেদনের নির্যাস, বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধের আওতায় নিয়ে আসা হোক। সেই বিষয়েই কেন্দ্রের অবস্থান জানতে চেয়েছিল শীর্ষ আদালত।দেবীপক্ষের সূচনালগ্নে হলফনামার আকারে কেন্দ্র জানায়, বৈবাহিক ধর্ষণকে আলাদা করে ফৌজদারি অপরাধের তকমা দেওয়া উচিত নয় কারণ আরও অনেক উপযুক্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা রয়েছে।কেন্দ্রের বক্তব্য, বৈবাহিক ধর্ষণ আসলে সামাজিক সমস্যা, আইনের বিষয় নয়।কেন্দ্রের এই অবস্থান আদতে বুঝিয়ে দিয়েছে,ভোটের বাজারে নারী সমাজ ‘লক্ষ্মী’ হলেও পুরুষতন্ত্রের শৌর্যের সামনে সরকারও নতজানু।
এখনও এ মামলার রায় ঘোষণা হয়নি,তবে শুনানি চলছে।দেশের অধিকারকর্মীরা,যারা দীর্ঘদিন ধরে ঔপনিবেশিক আমলের আইনটি সংশোধনের দাবি জানিয়ে আসছেন,তারা সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়।কেন্দ্রের অবস্থান জানার পরে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে,সরকারের যুক্তি আশ্চর্যজনক কিছু নয়,তবে এটি কঠোর পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় বসবাসকারী নারীর জন্য ‘পশ্চাৎপদতার’ নামান্তর নয় কি?এতদ্বারা কি প্রমাণিত হয় না যে,আমাদের দেশের নারীদের যৌন সহিংসতার শিকার হওয়াকে আমরা স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত করেছি?
ভারতে কোনও পুরুষ যদি তার স্ত্রীর সঙ্গে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেন এবং স্ত্রী যদি আঠারো বছরের বেশি বয়সি হন,তবে সেটি বৈবাহিক ধর্ষণ বলে বিবেচনা করা হয় না।এ ক্ষেত্রে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের পুরোনো আইন ধরে রেখেছে আমাদের দেশ। যদিও অনেক দেশ ইতিমধ্যে এই আইন সংশোধন করেছে। যে ব্রিটিশ প্রভুদের সৃষ্ট ফৌজদারি ও দেওয়ানি আইন নিয়ে ভারত ছিয়াত্তর বছর অতিবাহিত করেছে, সেই ব্রিটেনে ১৯৯১ সালে বৈবাহিক ধর্ষণকে বেআইনি ঘোষণা করেছে।সে দেশের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের সব কটিতেই বৈবাহিক ধর্ষণ অবৈধ।রাষ্ট্রপুঞ্জের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফসিএ) ২০২১ সালের একটি পর্যালোচনায় দেখেছে,প্রায় ৪০টি দেশে এখনও ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ বিরোধী কোনও আইন নেই।বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ হিসাবে ঘোষণার জন্য আদালতে আবেদন জানানো ব্যক্তিদের অন্যতম মারিয়াম ধাওয়ালে।তিনি নারী অধিকার সংগঠন অল ইন্ডিয়া ডেমোক্রেটিক উইমেন্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিবও বটে।তিনি বিশ্বাস করেন,বৈবাহিক সম্পর্কের ভেতরে কিংবা বাইরে -দুই ক্ষেত্রেই সম্মতি কোনও স্বতন্ত্র বিষয় নয়।সম্মতি সম্মতিই। তিনি মনে করেন, আমাদের দেশে নারীদের স্বাধীন মানুষ হিসেবে, স্বাধীন নাগরিক হিসাবে ভাবা হয় না।তিনি স্বামীর কাছে এক ধরনের অনুষঙ্গের মতো।তিনি অধস্তন,তার তেমন পৃথক সত্তা বা পরিচিতি থাকে না।
আইন পরিবর্তিত হলেই মানুষের চিন্তাধারায় পরিবর্তন আসে না।সেটি আনা অনেক বেশি কঠিন। তবে আইনের পরিবর্তন,এ সব স্পর্শকাতর ক্ষেত্রে অন্তত প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে। অধিকার কে আর কাকে দেয়,উচ্চৈঃস্বরে তাকে আদায় করেই নিতে হয়।আইনি বৈধতা না থাকলে সমাজ ও চারপাশে সহিংসতাকে নীরবে মেনে নেওয়ার এক ধরনের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে।পাল্টা যুক্তিতে কেউ বলতেই পারেন, সরকারকে সব দিক দেখতে হয়। প্রজাপালন, দুষ্টের দমন, শিষ্টের লালন, দুর্বলকে সহায়তা ও সুরক্ষা দান করা সবই সরকারের কাজ।কিন্তু তৎপরবর্তী প্রশ্নটি হতে পারে, তাহলে সামাজিক ন্যায়ের সংজ্ঞা কী?কীভাবে সামাজিক ন্যায় নিয়ে দাবির নিষ্পত্তি হবে?কীভাবে প্রয়োজনীয় ঐতিহাসিক ও সামাজিক বোধ বিচারবিভাগীয় যুক্তির অঙ্গ হবে,তার মূল প্রেরণা হয়ে উঠবে? আসলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নকে সমাজের পুনঃপ্রোথিত করা। সমাজবহির্ভূত যুক্তিবিন্যাসের নিয়ন্ত্রণ থেকে সামাজিক ন্যায়ের বিষয়টিকে মুক্ত করা।