রাজ্য মধ্যশিক্ষা পর্ষদের পরীক্ষা ফেব্রুয়ারী মাসে করার উদ্যোগ!!
বৈষম্যের নতুন মুখ!
দেশে ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গোটা দেশ জুড়ে একটাই মন্ত্র সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন যে, তিনি ডিজিটাল ভারত গড়তে চান। ডিজিটাল ভারত হলো- প্রযুক্তির সহজলভ্যতা ও সহজে পরিষেবা প্রদান করে জীবনযাত্রার মানকে সহজ করে তোলে। আসলে ডিজিটাল ইণ্ডিয়ার মাধ্যমে ভারত কীভাবে মানবজাতির উন্নয়নের জন্য প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার করবে- এটাই ছিল মোদির লক্ষ্য। কারণ যেসব দেশ সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণ করেনি, সময় তাদের পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে। তাই জন্মের শংসাপত্র থেকে শুরু করে, বিল জমা দেওয়া, ব্যাঙ্কের কাজ, রেশনের কাজ সবকিছুতেই দীর্ঘ লাইনে না দাঁড়িয়ে প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে কম সময়ে ঘরে বসে এগিয়ে যাওয়ার এই কর্মসূচির মাধ্যমে দুর্নীতি দূর করা, ডিজিটাল লেনদেনে দেশের জনগণের বিনিময় ব্যবস্থাকে সহজতর করতে এই উদ্যোগের কথা বলা হয়েছিল।
ডিজিটাল ইণ্ডিয়া স্লোগানের মধ্যেই কোভিড অভিমারি এসে স্কুল-কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যেও ঢুকে পড়েছিল অনলাইন পড়াশোনার জোয়ার। গত আট-নয় বছরের এই সময়টুকুতে ডিজিটাল ইণ্ডিয়ার সূর্যোদয় আদৌ ভারতে কতটা সিদ্ধিলাভ করেছে সেটা এখনই হয়তো হলফ করে বলা যাচ্ছে না। কিন্তু বিশ্বের সঙ্গে এক তালে পায়ে পা মিলিয়ে চলতে গিয়ে আমাদের ডিজিটাল ইণ্ডিয়ার দৌড় কতটা সাফল্যের মুখ দেখতে পারবে তা নিয়ে কিন্তু এরই মধ্যে প্রশ্ন দানা বাঁধতে শুরু করেছে। কারণ বহু মানুষ ডিজিটাল স্রোতে গা ভাসালেও সেই প্রযুক্তিকে নিজেদের কাজে ব্যবহার করতে গিয়ে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। নতুন প্রজন্মকে এই ডিজিটাল পদ্ধতি অনেকটাই কাছে টানলেও বাদবাকি বেশিরভাগ মানুষের কাছেই এই সম্পর্কিত ডিজিটাল জ্ঞানের অভাব এবং এই জাতীয় কোন ধারণা বা প্রশিক্ষণ না থাকায় একটা ভীতি ও আতঙ্ক কাজ করছে।
ডিজিটাল কাজকর্ম করতে গিয়ে অনেক মানুষেরই কালঘাম ছুটছে। এর উপর সাইবার ক্রাইম এবং এই সম্পর্কিত জালিয়াতি মানুষের মনে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। সবার আগে যে কথাটি জরুরি তা হলো দেশে বিরাট সংখ্যক নিরক্ষর মানুষের উপস্থিতি। একদিকে নিরক্ষরতা এবং পাশাপাশি প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব ভারতের মতো দেশে পরিস্থিতিকে কঠিন করে তুলেছে। আরেকটা কথা- ডিজিটাল ব্যবস্থায় ডুব দিতে গেলে চাই প্রয়োজনীয় অর্থ এবং ন্যূনতম শিক্ষা। ভারতের মতো দেশের গ্রামীণ এলাকায় এর দুটোর কোনটাই নেই। সবকিছুকে ছাপিয়ে সাম্প্রতিক অক্সফ্যাম ইণ্ডিয়ার এক রিপোর্ট ডিজিটাল ইণ্ডিয়ার স্লোগান ও কর্মযজ্ঞকে অনেকটাই যেন প্রশ্নচিহ্নে এনে দাঁড় করিয়ে গিয়েছে।
অক্সফাম ইণ্ডিয়া মাত্র সপ্তাহ আগে ইণ্ডিয়া ইনইক্যুয়ালিটি রিপোর্ট – ২০২২, ডিজিটাল ডিভাইস শিরোনামে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছে। সেই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ খুবই সীমাবদ্ধ। কারণটা হলো আমাদের দেশের ডিজিটাল প্রযুক্তি এখনও শহর এলাকায় উচ্চবর্ণের অভিজাত পরিবার কিংবা পুরুষ মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ২০১৮ সালের জানুয়ারী থেকে ২০২১ ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সেন্টার ফর মনিটরিং ইণ্ডিয়ান ইকনমি-এর সমীক্ষায় উঠে আসা তথ্যের বিশ্লেষণ এবং ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভের রিপোর্ট পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনার পর অক্সফাম এই গবেষণাপত্র তৈরি করেছে। এতে দেখা গেছে, ভারতে কম্পিউটার বা ল্যাপটপ রয়েছে মাত্র ৮ শতাংশ সাধারণ শ্রেণীর মানুষের হাতে।
আর তপশিলি উপজাতির কাছে এই সংখ্যাটা ১ শতাংশ, আর তপশিলি জাতিভূক্ত মানুষের কাছে ল্যাপটপ বা কম্প্যুটার ব্যবহারের সুযোগ আছে ২ শতাংশ। ২০২১ সালের ডিসেম্বরের পরিসংখ্যান ঘাঁটলে দেখা গেছে, ডিজিটাল ক্ষেত্রেও ভারতে রয়েছে লিঙ্গ বৈষম্য। ভারতে যদি ৬১ শতাংশ পুরুষের হাতে মোবইল ফোন থাকে, তাহলে মহিলাদের মাত্র ৩১ শতাংশের কাছে আছে মোবাইল ফোন। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতে কোভিড অতিমারি শুরুর আগে গ্রামীণ এলাকায় ৩ শতাংশ মানুষের কাছে কম্পিউটার ছিল। বর্তমানে আর্থিক সঙ্কটের প্রভাবে মহামারির পর তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১ শতাংশ। তেমনি ভারতে বেতনভুক্ত ৯৫ শতাংশ স্থায়ী কর্মচারীদের কাছেই মোবাইল রয়েছে।
যদিও বেকার অথচ ইচ্ছুক কর্মপ্রার্থী এ রকম ব্যক্তিদের কাছে মোবাইল ফোনের ব্যবহার মাত্র ৫০ শতাংশ। এই ডিজিটাল বিভাজন ভারতে ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের চিত্রটাকে আরও অসহনীয় করে তুলছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক স্তরে ব্যক্তি, পরিবার, ব্যবসা ও ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রস্তুতি এবং বিভিন্ন ধরনের কাজের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার করার সুযোগের মধ্যেও ব্যবধান বাড়ছে। এই ব্যবধান যে বৈষম্যের নতুন মুখ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই অসমতা কাটিয়ে ডিজিটাল ইণ্ডিয়া কতটা সিদ্ধিলাভ করতে পারবে সেটা সরকারের বাস্তবিক ইতিবাচক আন্তরিক পদক্ষেপের উপরই বেশিরভাগ নির্ভরশীল। সরকার সেই লক্ষ্যে কতটা কার্যকরী পদক্ষেপ নেয় সেটাই এখন মূল কথা ।