ভারত নতুন আলো, নতুন পথ দেখাবে

 ভারত নতুন আলো, নতুন পথ দেখাবে
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

১৫ -ই আগষ্ট , ২০২২ তারিখে , ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্ণ হবে । স্বাধীনতার এই অমৃত মহোৎসব উদযাপনের জন্য ইতিমধ্যেই নানা কর্মসূচি শুরু হয়েছে এবং সারা বছরব্যাপী সেসব চলবে । আমরা এখন একটি উৎসবের ভাবে আছি , কিন্তু এর মানে এই নয় যে আমাদের সামনে কোনও চ্যালেঞ্জ বা সমস্যা নেই । অনেক সমস্যার সমাধান ইতিমধ্যে হলেও আরও কিছু নতুন সমস্যাও দেখা দিয়েছে । তবে সমস্যা যাই থাকুক না কেন স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবের আনন্দ আমরা যাপন করব এবং এটাই স্বাভাবিক । ১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগষ্ট , বহু শতাব্দী পর আমরা আমাদের ইচ্ছানুযায়ী স্ব – শাসন প্রতিষ্ঠা করতে এবং স্ব – শাসনের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছিলাম ; আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে , আমাদের জাতীয় পতাকার নীচে , বিশাল ভারতবর্ষের অবস্থান । এই স্বাধীনতা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে ভারতের মানুষ সম্পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত না হয়ে দাসত্ব ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে নিরলস সংগ্রাম করেছিল । ভৌগোলিক দিক থেকে , বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে ভারতীয় জনগণের এই সংগ্রাম ছিল সর্বব্যপ্ত এবং সর্বাঙ্গীণ । সমাজের সকল শ্রেণি তাদের সামর্থ্য , ক্ষমতা ও শক্তি অনুযায়ী স্বাধীনতা আন্দোলনে অবদান রেখেছিল । যেসব কারণ আমাদের স্বাধীনতার পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিল সেগুলি সম্পর্কে দেশের মানুষ ক্রমশ সচেতন হয়ে উঠেছিলো । একদিকে যখন স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র ও নিরস্ত্র সংগ্রাম জোরদার হতে থাকে , অন্যদিকে তখন সমাজকে কুসংস্কারমুক্ত করার এবং সম্মিলিত স্বার্থে কাজ করার জন্য জাগ্রত করার প্রচেষ্টাও গ্রহণ করা হয়েছিলো । এই নিরলস প্রচেষ্টার জন্যই ১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগষ্ট , আমরা আমাদের ইচ্ছানুযায়ী , আমাদের পছন্দ অনুযায়ী , আমাদের নিজস্ব লোকদের দ্বারা আমাদের দেশ পরিচালনার অধিকার অর্জন করেছি । ভারতের মাটি থেকে আমরা ব্রিটিশ শাসকদের বিদায় জানিয়ে আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনা , পরিচালনা এবং প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করি । সুতরাং , খুব সঙ্গতভাবেই আমাদের মাতৃভূমির স্বাধীনতার ৭৫ বছর আমরা উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে উদযাপন করছি। দীর্ঘ সময়ের স্বাধীনতা সংগ্রামে অসংখ্য মানুষ , যারা প্রকৃত বীর , তারা নিজের জীবনসহ সবকিছু বিসর্জন দিয়েছিলেন । তাদের দৃঢ় চরিত্র দেশপ্রেম এবং মাতৃভূমির প্রতি ভক্তি সম্পর্কে সমগ্র সমাজকে অনুপ্রাণিত করার জন্য তাদের বীরত্ব ও ত্যাগের কাহিনি প্রচার করতে হবে । অনেক আপাতদৃষ্টিতে ছোট – বড় ঘটনা অথবা ছোট বড় কাজ ছিল যা আমাদের জাতির উপর দীর্ঘস্থায়ী তারা জীবন দিয়ে পালন করেছিলেন তা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণে রাখা উচিত । দেশে কেন স্বরাজ্য দরকার ? বিদেশি শক্তি দেশের নাগরিকদের জন্য এবং তথাকথিত উন্নয়নের কাজ করলেও কেন তাদের দ্বারা একটি দেশ শাসিত হওয়া উচিত নয় ? আত্মনিয়ন্ত্রণের ও আত্মপ্রকাশের অধিকার যে কোনও সমাজের জন্য মৌলিক । এইভাবে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা সহজাত অনুপ্রেরণা প্রদান করে । একটি দেশ তখনই যথার্থভাবে পরিচালিত হতে পারে যখন এটি স্বাধীন হয় এবং নিজের জন্য প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিজেরাই গ্রহণ করতে পারে । স্বামী বিবেকানন্দ একবার বলেছিলেন , “ প্রত্যেক জাতির সৃষ্টি হয় বিশ্বের জীবনে অর্থবহ কিছু অবদান রাখতে । ” যে কোনও কিছুতে অবদান রাখতে হলে জাতিকে একই সঙ্গে স্বাধীন ও সক্ষম উভয় হতে হবে । এগুলো মৌলিক এবং তাই অপরিহার্য । স্বামী বিবেকানন্দের মতো , বেশ কয়েকজন মহান ব্যক্তি , যারা ভারতের জনগণকে জাগিয়ে তোলার জন্য কাজ করেছিলেন এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য সশস্ত্র ও নিরস্ত্র বিপ্লবকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন , তারা তাদের নিজস্ব ভাষায় বর্ণনা করেছেন— শুধুমাত্র স্বাধীনতা অর্জনই অপরিহার্য নয় বরং কীভাবে তার প্রয়োগ ও সংরক্ষণ হচ্ছে তাও বিবেচ্য । শ্রদ্ধেয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর , তাঁর বিখ্যাত কবিতা “ চিত্ত যেথা ভয়শূন্য , উচ্চ যেথা শির ‘ এবং মহাত্মা গান্ধী তাঁর ‘ হিন্দ – স্বরাজ ’ উদ্ধৃতির মাধ্যমে স্বাধীন ভারত সম্পর্কে ধারণাগুলি বিশদভাবে তুলে ধরেছেন । স্বাধীনতা সংগ্রামী বীর সাভারকর তাঁর বিখ্যাত ‘ স্বতন্ত্র – দেবী আরতি ’ তে স্বাধীন দেশে সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ এবং শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলেছেন । আমরা ডক্টর বি আর আম্বেদকরের অবদান অস্বীকার করতে পারিনা ; তার দুটি বিখ্যাত বক্তৃতা আছে— যেখানে তিনি স্বাধীনতার অর্থ , উদ্দেশ্য , যুক্তি এবং একটি মহান জাতি গঠনের জন্য প্রতিটি ভারতীয়র কি কতর্ব্য এবং কোন পথ অনুসরণ করা উচিত সে অমৃত মহোৎসব উদযাপনের এই শুভক্ষণে আমাদের আত্মসমীক্ষা করা উচিত যে স্বাধীনতার উদ্দেশ্য যদি স্বনির্ভরতা অর্জন করা হয় , তবে আজ ৭৫ বছর পর , ভারতবর্ষ কি সম্পূর্ণ আত্মনির্ভর হতে পেরেছে । ভারতকে যদি বিশ্বমঞ্চে যথার্থ অবদান রাখতে হয় , তবে প্রথমে কি তাকে সব দিক দিয়ে স্বনির্ভর হতে হবে । ভারতবর্ষ কি সমস্ত ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন করেছে ? ১৯৪৭ সালে , আমরা ভারতকে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং যুগান্তর আনার শপথ নিয়েছিলেন— যেখানে ভারত নতুন আলো , নতুন পথ দেখাবে এবং অবশিষ্ট বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবে । কিন্তু , এর জন্য , আমাদের চিন্তা ও কর্ম উভয় ক্ষেত্রেই যথেষ্ট স্বচ্ছতা , দৃঢ়তা এবং উপযুক্ত দিকনির্দেশনার প্রয়োজন । ভারতের চিরন্তন দৃষ্টি , তার চিন্তাধারা এবং সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো ঐক্যের ভাব , সামঞ্জস্য এবং সম্পূর্ণতা । এই সংস্কৃতি চর্চারমাধ্যমে বিশ্বকে বার্তা দেয় । যেহেতু ভারতের একাত্মতা স্বাভাবিক , বিরোধমুক্ত সার্বজনীন , চিরন্তন , যুক্তিভিত্তিক এবং বৈজ্ঞানিক সত্যের উপর ভিত্তি করে তার ফলে সম্প্রীতি অটুট থাকে । এদেশে বৈচিত্র্যর মধ্যেও ঐক্যের প্রকাশ ঘটে ; বৈচিত্র্য মানে পার্থক্যের প্রকাশ নয় । ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য , সকলকে একইরকম হতে হবে না । যদি কেউ সকলকে একইরকম হতে বাধ্য করে তখন বিরোধ এবং বৈষম্যের আশঙ্কা দেখা দেয় । আমাদের একে অপরের মধ্যে আপাতদৃষ্টির পার্থক্য বুঝতে এবং সম্মান করতে হবে এবং একটি ঐক্যবদ্ধ সমাজ গঠনের জন্য তাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে । আমরা সবাই মা ভারতীর জন্য নিবেদিত সন্তান । এই বোধ আমাদের পরস্পরকে বন্ধনে আবদ্ধ করে । সহৃদয়তা , বন্ধুত্ব , আন্তরিকতা ইত্যাদি যা আমাদের চিরন্তন সংস্কৃতি তা আমাদের হৃদয়ে উন্নত জ্ঞানের সৃষ্টি করে । হৃদয়ের পবিত্রতা থেকে প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতা পর্যন্ত এই পবিত্রতা জ্ঞান ও প্রজ্ঞার জন্ম দেয় । প্রাচীন ও ঐতিহাসিক কাল থেকেই আমাদের পূর্বপুরুষেরা আমাদের এই জ্ঞানের পথ ধরে অগ্রগতি অর্জনের প্রেরণা দিয়েছেন । আমরা সবাই একই পবিত্র সন্তান । আমরা আমাদের সাদৃশ্য উপলব্ধি করবো , আপাত বিভিন্নতাকে সম্মান করবো , স্বার্থপর মনোভাব ত্যাগ করবো , সমস্ত বৈষম্য পরিহার করবো এবং সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে দেশ সময়ের এই দাবি মেনে চলবো সমগ্র সমাজকে একত্রিত হওয়া উচিত এবং এই বিশ্বাস নিয়ে দাঁড়ানো উচিত । সময়ের সাথে সাথে , – বৈষম্য , ক্ষুদ্র স্বার্থপরতা ইত্যাদি কিছু অশুভ প্রবণতা আমাদের সমাজকে ক্রমাগত জর্জরিত করে চলেছে । এগুলি পার্থিব -সুবিধা , সম্পদ এবং বস্তুগত পরিতৃপ্তির আকাঙ্ক্ষা থেকে উদ্ভূত হয় । আদর্শ আচরণের অনুকরণীয় জীবনযাপনের মধ্যে দিয়ে আমাদের ভাবনা , বাক্য এবং কার্যকলাপকে এ ধরনের অশুভ প্রবণতা থেকে মুক্ত করতে পারি । এই ধরনের আলোকময় জীবনের অনুধ্যান আদর্শ সমাজ গঠনে সাহায্য করে । একটি ন্যায় – ভিত্তিক এবং শোষণমুক্ত সমাজ যে অভ্যন্তরীণ শক্তি তৈরি করে তার দ্বারা স্বাধীনতা সুরক্ষিত হয়। নানারকম স্বার্থান্বেষী শক্তি , সংগঠন এবং ব্যক্তি আছে যারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের মধ্যে বিভ্রান্ত , উস্কানি বা সংঘাত সৃষ্টি করে সমাজকে বিভক্ত করার অপচেষ্টা করে চলেছে । এই অশুভ শক্তিগুলো শুধু দেশের ভেতরেই নয় , দেশের বাইরে থেকেও একই কাজ করে থাকে । সমাজ সজাগ , সুসংগঠিত এবং শক্তিশালী হলে এইসব অপশক্তির বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে পারে । আমাদের অবশ্যই সমাজের প্রতিটি স্তরের মধ্যে নিরন্তর এবং স্বচ্ছ সম্পর্ক বজায় রাখার সুত্রগুলি উন্নত করতে হবে । একটি মুক্ত ও গণতান্ত্রিক দেশে , নাগরিকদের নিজেদের জন্য তাদের প্রতিনিধি বাছাই ও নির্বাচন করার অধিকার রয়েছে । আর এই সব নির্বাচিত প্রতিনিধিদের উচিত তাদের সামর্থ্য ও বিচক্ষণতার সর্বাধিক প্রয়োগ করে দেশের সার্বিক স্বার্থে কাজ করা । দলীয় আদর্শের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত । তাদের অবশ্যই আইন , সংবিধান , নাগরিক শৃঙ্খলা সম্পর্কে সাধারণ বোধ রাখতে হবে এবং একটি সফল গণতন্ত্রের জন্য এর যথাযথ পালন সবচেয়ে প্রয়োজনীয় । তবে সাম্প্রতিক সময়ে এইসব গুণাবলির কিছু অবনতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে । আমরা সবাই দেখছি কিভাবে স্রেফ রাজনৈতিক— চমক ও ছলচাতুরীর কারণে সমাজের ভাঙন বা অবক্ষয় ঘটছে । মানুষের মধ্যে উত্তেজনার সময় , নিজের বীরত্ব প্রমাণ করার জন্য লাগামহীন বক্তব্য রাখা ( যা এখন সোশ্যাল মিডিয়াতে একটি সাধারণ নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে ) ও এই ভাঙন সৃষ্টির একটি বড় কারণ । এর ফলে রাজনীতি দেশের স্বার্থ থেকে দলের স্বার্থে চলে যাচ্ছে ; এবং তারপর একমাত্র কাজ হচ্ছে অন্যদের হেয় প্রতিপন্ন করা । নেতৃত্বসহ আমাদের প্রত্যেকের উচিত এ ধরনের আচরণ থেকে দূরে সরে নাগরিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা । আইনের শাসন মানতে হবে এবং সমাজে সমুন্নত পরিবেশ তৈরি করতে হবে। পৃথিবীর যে কোনও স্থানে যে কোনও ধরনের পরিবর্তন তখনই আনা সম্ভব যখন সমাজ নিজেই সক্ষম , যোগ্য এবং কার্যক্ষম হবে । সমাজ দুর্বল , অরক্ষিত বা ভঙ্গুর হলে কোনও পরিবর্তন দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না । সমাজের সুপ্রাচীন ও প্রচলিত আধুনিক ব্যবস্থা উভয়ের ভালো ভালো দিক গ্রহণ করে ‘ স্ব ’ ভিত্তিক একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে চারটি মৌলিক গুণ থাকতে হবে- ‘ স্ব ’ সম্পর্কে স্পষ্ট জ্ঞান , দেশপ্রেম , ব্যক্তি ও সামাজিক শৃঙ্খলা এবং ঐক্যের অনুভূতি । উচ্চতর বস্তুবাদী জ্ঞান , উচ্চ মানের দক্ষতা , সুশাসন , প্রশাসন ইত্যাদি শুধুমাত্র সেই সমাজ ও দেশকে সাহায্য করবে যেটি ঐক্যবদ্ধ থাকবে । ‘ স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব ’ উদযাপনের এই শুভক্ষণ আমরা অনেক ত্যাগ ও কষ্টের পরেও অর্জন করেছি । ভারতকে তার গৌরবের শিখরে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের একই ভাবে নিষ্ঠার সাথে কঠোর পরিশ্রম করে যেতে হবে । আসুন আমরা উদ্যম , দৃঢ়তা এবং সংকল্পের সঙ্গে এই যাত্রাকে ত্বরান্বিত করি । ( লেখক ড . মোহন ভাগবত আরএসএস এর সরসঙ্ঘচালক )

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.