মণিপুরে মৌন মোদি।

 মণিপুরে মৌন মোদি।
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

পৃথিবীতে এ পর্যন্ত এমন কোনও নজির নেই, যেখানে শুধুমাত্র শান্তি কমিটি গঠন করেই জাতিগত হিংসা বা অনৈক্য নির্মূল করা গেছে। কারণ শান্তি কমিটি তখনই গঠন করা হয়, যখন প্রতিদ্বন্দ্বী দুই বা তিনটি সম্প্রদায়ের মধ্যে অস্থির ও অবিশ্বাসের বাতাবরণের পরিপ্রেক্ষিতে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠে। আর এই শান্তি কমিটির তখন প্রধান দায়িত্ব হয়ে উঠে বিবদমান মানুষদের মধ্যে আস্থা জাগানোর পরিবেশকে পুনরুদ্ধার করা। আর এই দায়িত্ব পালন করতে গেলে শুধু প্রশাসনের উদ্যোগে সভাসুন্দর শাস্তি কমিটি গঠন করলেই সব ল্যাটা চুকে যায় না। শাস্তি কমিটিতে যারা থাকবেন, তাদের প্রতি জনগণের একশ শতাংশ আস্থা ও বিশ্বাস সবার আগে জরুরি। যদি তা না হয় তাহলে সবটাই কার্যত একটা প্রহসনে পরিণত হয়। উত্তর পূর্বের অন্যতম ছোট্ট রাজ্য, ত্রিপুরার প্রতিবেশী মণিপুরে যে নজিরবিহীন নৈরাজ্য গত দেড়মাসের বেশি সময় ধরে ঘটে চলেছে সেটাও সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের ভৌগোলিক পরিসীমার মধ্যে ঘটে যাওয়া বড়সড় প্রহসনাত্মক নজির। প্রায় এক মাসের বেশি সময় ধরে জাতিগত হিংসা চলছে। শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন কয়েক সহস্র মানুষ। লক্ষাধিক বাড়িঘর পুড়েছে। ঘরবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু জীবন কাটাচ্ছেন আরও অগণিত মানুষ। মোদি মন্ত্রিসভার সদস্য বিদেশ প্রতিমন্ত্রী রাজকুমার রঞ্জন সিং বলেছেন, মণিপুরে আইন শৃঙ্খলা ভূমিশয্যা নিয়েছে। মোদি ঘনিষ্ঠ মণিপুরে বসবাসরত লেফটেন্যান্ট জেনারেল এল নিশিকান্ত সিং টুইট বার্তায় লিখেছেন, “রাষ্ট্র এখন রাষ্ট্রহীন, মণিপুর পরিস্থিতি যেন অনেকটা লিবিয়া লেবানন, নাইজেরিয়া ও সিরিয়ার মতোই।” এভাবেই গত চল্লিশ দিন ধরে মণিপুর পুড়ছে হিংসার আগুনে। অথচ রাজ্যপাল সঙ্কট মোকাবিলায় মণিপুরে ৫১ সদস্যের একটি শান্তি কমিটি গঠন করেছেন।এই তথাকথিত শান্তি কমিটিতে কুকি, মেইতেই, নাগা, নেপালি, মুসলিম সকলকেই স্থান দেওয়া হয়েছে। আছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংও। শুরুতেই এই শান্তি কমিটিকে বয়কট ও প্রত্যাখ্যান করেছে মণিপুর অখণ্ড সমন্বয়কারী কমিটি। কুকি ইনপি মণিপুর বিবৃতি দিয়ে বলেছে তাদের সঙ্গে কোনও আলোচনা ও পরামর্শ ছাড়াই কমিটিতে তাদের স্থান দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে উদ্বেগের ঘটনা হলো, যাকে নিয়ে মণিপুরে শাস্তি কমিটি গড়া হয়েছে, সেই মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংয়ের বিরুদ্ধে কুকি, ইনপি মণিপুর সবচেয়ে সরব। মুখ্যমন্ত্রী বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে মণিপুর সরকার হিংসা ও হামলা হুজ্জতিতে মদত জোগাচ্ছেন এবং কুকিদের বিরুদ্ধে মৌলবাদী ও চরমপন্থী দুই গোষ্ঠীকে দিয়ে হামলা ঘটিয়ে যাচ্ছে এরকমই গুরুতর অভিযোগ কেআইএমের। প্রশ্ন হলো, কেন্দ্রের নির্দেশেই রাজ্যপাল মণিপুরে শাস্তি কমিটি গঠন করছেন। এই কমিটির সার্থকতা নির্ভর করবে কমিটির সদস্যদের বিশ্বাসযোগ্যতা ও সদিচ্ছার উপর। অথচ খোদ মুখ্যমন্ত্রী যিনি শান্তি কমিটির সদস্য তার বিরুদ্ধেই অনাস্থা, হিংসায় মদত দেওয়া, প্রতিপক্ষ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে হানাদারি, অন্য গোষ্ঠীকে দিয়ে পৃষ্ঠপোষকতা করার মতো গুরুতর অভিযোগ যখন প্রকাশ্যে আসে তখন কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর হিরন্ময় নীরবতা সন্দেহ ও গুঞ্জনকে আরও বাড়িয়ে দেয়। মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংয়ের উপর কুকি সহ বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং বিভিন্ন সামাজিক সংস্থাগুলো যখন অনাস্থা ব্যক্ত করেন তখনও মোদি-শাহরা যদি বীরেন সিংয়ের উপর আস্থা-ভরসায় অটুট থাকেন তখন বুঝতে বাকি থাকার কথা নয় মণিপুরে ১ মাসের বেশি সময় ধরে চলা হিংসার উপর কেন ডবল ইঞ্জিন সরকার নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারছে না। একদিকে মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংয়ের ব্যর্থতা আর এর পাশাপাশি মোদি-শাহর নীরবতা মণিপুরের পরিস্থিতিকে যেভাবে খাদের কিনারায় এনে ঠেলে দিয়েছে তাতে মণিপুর অচিরেই শুধু পূর্বোত্তর নয়, গোটা দেশের জন্য আবারও বড়সড় মাথাব্যথার কারণ না হয়ে দাঁড়ায় সেই আশঙ্কাটাই এখন তাড়া করছে বিভিন্ন মহলে। অগ্নিগর্ভ মণিপুর নিয়ে মণিপুরের ১০ বিরোধী দলের নেতারা প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ চেয়ে চিঠি পাঠিয়ে দিল্লীতে ঠায় বসে আছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সময় নেই। আসলে এটা নতুন কোনও বিষয় নয়। মোদি জামানার ৯ বছর এটাই দেখে দেখে অভ্যস্ত দেশ। বিজেপি শাসিত রাজ্য উত্তর প্রদেশেই হোক বা হরিয়ানা। হিংসার আগুনে, রক্ত ঝড়লে কিংবা কোনও অনৈতিকতার বিরুদ্ধে সারা দেশে আওয়াজ উঠলেও গেরুয়া প্রভুরা নীরব। আর অবিজেপি শাসিত রাজ্যে কোনও প্রতিক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় টিম, তদন্তকারী দল সব ছুটে যায়। এভাবেই ধর্মপুত্ররা রাজধর্মের পরিবর্তে দলীয় নীতি-আদর্শ ও লাভালাভের রাজনীতিতে মজে গিয়ে দেশের সামনে সামাজিক সুস্থিতির সামনে যে বিপদ বাড়িয়ে চলেছেন তা গণতন্ত্রের জন্য শুধুই অশনিসংকেতই নয়, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকেও দুর্বল করার পক্ষে যথেষ্ট। মণিপুরে জাতি হিংসার মধ্যে পুলিশের অস্ত্রাগার কীভাবে লুঠ হয়ে যায়। সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হাতে কীভাবে এত মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র চলে আসে। সেনাবাহিনীর ঘাড়ে সব দায় ঝেড়ে ডবল ইঞ্জিন সরকার কড়া দাওয়াইয়ের কথা বললেও রাতের অন্ধকারে কীভাবে একটি বিশেষ জাতিগোষ্ঠীর অধ্যুষিত গ্রামে বহ্ন্যুৎসব ঘটে যায় এই প্রশ্নগুলোর উত্তর কিন্তু শান্তি কমিটিতে বীরেন সিংয়ের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে উত্থাপিত আপত্তির মধ্যেই নিহিত রয়েছে। তাই মোদি-শাহরা নীরব। মণিপুরের শাস্তিও তাই আপাতত অধরা।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.